বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বের বিস্ময় বালক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন বৈভব সূর্যবংশী (Vaibhav Suryavanshi)। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ক্রিকেটের বড় বড় মঞ্চে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছেন, তা রূপকথাকেও হার মানায়। বিহারের এক সাধারণ গ্রাম থেকে উঠে আসা এই কিশোরের সাফল্যের প্রতিটি ধাপ নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
বৈভবের জন্ম ২০১১ সালের ২৭ শে মার্চ। তিনি বিহারের সমস্তিপুর জেলার মতিপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম সঞ্জীব সূর্যবংশী। বৈভবের আজকের এই অবস্থানের পেছনে তার বাবা-মায়ের রয়েছে অসামান্য ত্যাগ। তার মা প্রতিদিন রাত ১১টায় ঘুমাতেন এবং রাত ২টোয় উঠে বৈভবের জন্য রান্না ও প্রস্তুতির কাজ শুরু করতেন, যাতে সে ভোর ৫টায় অনুশীলনের জন্য বাড়ি থেকে বের হতে পারে।
শৈশব ও ক্রিকেটের প্রতি হাতেখড়ি (২০১৬-২০ ২০২১)
মাত্র ৫ বছর বয়সে ২০১৬ সালে বৈভব প্রথম ক্রিকেট ব্যাট ধরেন। তার ব্যাটিং টাইমিং দেখে বাবা সঞ্জীব সূর্যবংশী বুঝতে পারেন ছেলের মধ্যে বিশেষ প্রতিভা আছে। ছেলের স্বপ্ন পূরণে তিনি নিজের ব্যবসা ও কৃষিকাজ—সবকিছু ত্যাগ করেন। বাড়ির পেছনে একটি পিচ তৈরি করে তিনি নিজেই বৈভবকে প্র্যাকটিস করাতেন। এমনকি নিজের কাজ ফেলে তিনি গ্রামের ছেলেদের ডেকে এনে তাদের দায়িত্ব দিতেন বৈভবকে বল করার জন্য, যাতে বৈভবের প্র্যাকটিসে কোনো কমতি না থাকে।
কঠোর পরিশ্রম ও দীর্ঘ পথচলা
৯ বছর বয়সে বৈভবকে সমস্তিপুর এবং পাটনার দুটি আলাদা একাডেমিতে ভর্তি করানো হয়। পাটনার ভালো একাডেমিতে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা সময় যাতায়াতেই ব্যয় হতো। ৩ ঘণ্টা যাওয়া এবং ৩ ঘণ্টা আসা—এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েই চলত তার ক্রিকেটের সাধনা। ১০ বছর বয়সেও তার বাবা তাকে একা ছাড়তেন না, নিজেই সাথে করে নিয়ে যেতেন। ছেলের ক্যারিয়ারের জন্য তার বাবা দীর্ঘ সময় কার্যত বেকার থেকেছেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটের রেকর্ডসমূহ
- বিনু মানকড় ট্রফি: ১২ বছর বয়সে এই অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে ৫ ম্যাচে ৪০০ রান করে তিনি সবার নজর কাড়েন।
- প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট: মাত্র ১২ বছর ২৮৪ দিন বয়সে বিহারের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক ঘটে তার। শুরুতে কিছুটা ফর্মের ঘাটতি থাকলেও বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন তার ওপর আস্থা বজায় রাখে।
- অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তান্ডব: ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৫৮ বলে সেঞ্চুরি করে তিনি সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
আইপিএল ২০২৫: বিশ্বমঞ্চে রেকর্ড ভঙ্গ
নিলামের আগে রাজস্থান রয়্যালসের ট্রায়ালে বৈভব দুর্দান্ত পারফর্ম করেন। ট্রায়ালে কোচ তাকে ৬ বলে ১৭ রান করার চ্যালেঞ্জ দিলে তিনি মাত্র ৩ বলে ৩টি ছক্কা মেরে ১৮ রান করেন। ২০২৫ সালের নিলামে রাজস্থান রয়্যালস তাকে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকায় দলে নেয়।
১৯ এপ্রিল ২০২৫-এ লখনউ সুপার জায়ান্টসের (LSG) বিপক্ষে অভিষেকেই তিনি শার্দুল ঠাকুরকে প্রথম বলে ছক্কা মারেন। সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে ম্যাচটি। সেই ম্যাচে বৈভব মাত্র ৩৫ বলে সেঞ্চুরি করেন। এটি আইপিএল ইতিহাসের দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি এবং ভারতীয়দের মধ্যে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। এই ইনিংসের মাধ্যমে তিনি ইউসুফ পাঠানের দীর্ঘদিনের রেকর্ড ভেঙে দেন।
বিজয় হাজারে ট্রফি ও নতুন বিশ্বরেকর্ড
বৈভব তার ফর্ম ধরে রেখে বিজয় হাজারে ট্রফিতে অরুণাচল প্রদেশের বিপক্ষে মাত্র ৮৪ বলে ১৯০ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন। তার এই ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের ওপর ভর করে বিহার দল ৫০ ওভারে ৫৭৪ রান তুলে এক নতুন বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে।
সরকারি স্বীকৃতি ও সম্মাননা
ক্রিকেট মাঠে বৈভবের এই অভাবনীয় সাফল্য এবং বিহারের নাম উজ্জ্বল করার জন্য সম্প্রতি তাকে সরকারিভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বিহার সরকার এবং ক্রীড়া মন্ত্রক তার অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছে। এই পুরস্কার তার কঠোর পরিশ্রম এবং তার পরিবারের আত্মত্যাগের প্রতি একটি বড় সম্মান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বয়স বিতর্ক ও বিসিসিআই-এর স্বীকৃতি
বৈভবের বয়স নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক উঠলেও তার বাবা স্পষ্টভাবে জানান যে, বিসিসিআই (BCCI) যথাযথ পরীক্ষা ও হাড়ের পরীক্ষার (Bone Test) মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে যে তার বয়স বর্তমানে ১৪-এর কাছাকাছি এবং এটি সম্পূর্ণ সঠিক ও বৈধ তথ্য।
উপসংহার
২০২৫ আইপিএলে বৈভবের স্ট্রাইক রেট ছিল ২০৬.৫৬, যা সেই আসরে ২৫০-এর বেশি রান করা খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। ৫ বছরের সেই ছোট ছেলেটি আজ তার বাবার আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ব ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ছন্দ বজায় থাকলে খুব শীঘ্রই তিনি শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড ভেঙে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলে অভিষেক করবেন।
Your comment will appear immediately after submission.