জীবনে কিছু গল্প শুধু পড়ার জন্য নয় — মনে গেঁথে রাখার জন্য আসে।
এই গল্পটাও তেমন — এক মা, যিনি প্রতিদিন রিকশা চালান।
কিন্তু তার চাকার ঘূর্ণন থেমে যায় না কোনও গন্তব্যে,
বরং সে ছুটে চলে — এক ভবিষ্যতের দিকে,
যেখানে তার সন্তান দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের গেটের সামনে, হাতে বই, চোখে স্বপ্ন।
তিনি কোনও ফেসবুক ভাইরাল নন,
তিনি টিভির অতিথিও নন, কেউ তাকে “মাদার অব দ্য ইয়ার” বলেনি কখনও।
তবু তিনি আছেন —
প্রতিদিনের রোদে, কাঁধে ভার, চোখে নীরবতা নিয়ে।
তার কাঁধে বই ঝোলেনা,
কিন্তু সেই কাঁধেই উঠে দাঁড়ায় একটি ছোট হাত —
যে বলে, “মা, আমি একদিন ডাক্তার হবো।”
**এই লেখাটি কেবল তার গল্প নয়।
এই লেখাটি তাদের জন্য —
যারা কোনদিন ক্লাসের বেঞ্চে বসার সাহস হারিয়ে ফেলেছে।
যারা বলেছে, “আমি গরিব, আমি পারবো না।”
এই লেখাটি তাদের মনে জোরে জোরে বলবে —
“তোমার মা যদি তোমার পাশে দাঁড়ায়, তাহলে জীবনও হার মানে।”
সাধারণ রাস্তায় অস্বাভাবিক এক মা
দিনের সূর্য যখন পিঠে পড়ে, মা তখন চালান জীবনকে
সকাল ৮টা।
অফিসযাত্রীদের ভিড়ে রাস্তায় গুঞ্জন।
হলুদ রঙা রিকশার হ্যান্ডেলে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন তিনি —
হাতে গ্লাভস নেই, মুখে ছায়া নেই, তবু চোখে ঝকমক করছে কিছু।
না, সেটা ক্লান্তি না… সেটা আশা।
যখন সূর্য তার পিঠে পড়ে — তখনও তিনি মাথা নিচু করেন না।
কারণ তার ছেলেটা, যাকে তিনি স্কুলে নামিয়ে দেন, তার চোখে নাকি একদিন সরকারি পরীক্ষার ফলাফল আসবে।
সেখানে লেখা থাকবে — “আমি পাস করেছি, মা!”
এই মায়ের কাছে রিকশা একটা বাহন নয়, এটা একটা মিশন।
প্রতিটি প্যাডেল তার ছেলের স্বপ্নের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যায়।
আশপাশের লোকের চোখে সে শুধুই ‘রিকশাওয়ালা’, সন্তানের চোখে সে সুপারহিরো
বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলে,
“এই রিকশাওয়ালি মেয়েটা রোজ এখানে আসে…”
আরেকজন মুখে তাচ্ছিল্যের সুরে ফিসফিস করে —
“মেয়েমানুষ হয়ে রিকশা চালানো… আহা!”
কিন্তু ওই শিশু, স্কুলের গেটের পাশে দাঁড়ানো সেই ছোট্ট ছেলে —
যখন দেখেন তার মা ভেজা গায়ে এসে দাঁড়িয়েছে,
তখন তার চোখে মায়ের পরিচয় হয় না কোনো রিকশাওয়ালা,
তার চোখে মা = Superwoman
যে লড়ে, যে চালায়, যে গড়ে — আর সেই গড়ে ওঠা থেকেই জন্ম নেয় একজন মানুষ।
এই মায়েরা ক্যাপ পরেন না, কিন্তু তারা হিরো।
তাদের গায়ে লাল বা নীল চাদর উড়ে না,
তবু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপই হয়ে ওঠে একেকটা মহাকাব্য।
শিক্ষার জন্য মায়ের যুদ্ধ – কাগজের বইয়ের চেয়ে ভারী তার ঘাম
সন্তানের পড়ালেখার খরচ কীভাবে জোগাড় করেন
নতুন ক্লাসে ভর্তির সময় আসলেই বাড়ে মায়ের রিকশার গতি।
কোনোদিন ৮টা থেকে ১২টা, আবার কোনোদিন সন্ধ্যা ছুঁয়ে রাত ৯টা অবধি।
বাড়ি ফিরে পিঠে ব্যথা, হাতে ফোস্কা — তবু নীরব মুখে পানির গ্লাস তুলে নেন,
কারণ সামনে রাখা ছেলের বই-খাতা গুলোকে তিনি কাঁপতে দিতে চান না।
যে দিন স্কুলে ফি দেওয়ার শেষ দিন থাকে,
সেই দিন মায়ের রিকশা যেন উড়ে চলে – একেকটা যাত্রা, যেন একেকটা যুদ্ধ।
তিনটে রাইড কম হলে টিফিন কেনা হবে না,
একটা রাইড মিস মানে খাতা কেনার পেছনে হিসেব কষা রাত।
কেউ বোঝে না, সে কেন ছেলেটাকে প্রতিদিন একটু আগে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে,
রাস্তায় পা চালাতে থাকে না এক মুহূর্ত থেমে।
কারণ সে জানে — শিক্ষা বিনা সন্তান এক কাঠামো, আর শিক্ষা থাকলে সে এক মন্দির।
মায়ের মুখে ক্লান্তি নেই, আছে শুধু জেদ আর স্বপ্ন
সূর্য মাথার ওপরে, ধুলো উড়ছে, ট্রাফিক থেমে গেছে —
তবু তার মুখে নেই বিরক্তি, নেই অভিযোগ।
তার চোখে ভাসে শুধু একটা দৃশ্য:
সন্তান একদিন দাঁড়িয়ে বলছে, “মা, আমি আজ চাকরি পেলাম।”
কেউ কেউ বলে: “রিকশা চালিয়ে আর কী হবে?”
তিনিও বলেন না কিছু —
তবে রাতে ছেলেকে পড়তে বসিয়ে যখন চুপিচুপি একটা ছেঁড়া রুমালে ঘাম মুছেন,
তখন তার ভিতরের সেই যোদ্ধা চিৎকার করে বলে ওঠে,
“হবে, হবেই — আমার ছেলেও একদিন সবার উপরে থাকবে।”
এই মায়ের মুখে ক্লান্তি নেই,
কারণ সে কাঁদে না — সে লড়ে।
সে চায় না সহানুভূতি — সে চায় সম্ভাবনা।
সন্তানের চোখে মা — এক অধ্যায়, এক বিশ্ববিদ্যালয়
ছেলে বা মেয়েটি কীভাবে মাকে দেখে
প্রথম প্রথম সে লজ্জা পেত।
মা রিকশা চালিয়ে তাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যেত, আর বন্ধুরা ফিসফিস করত—
“ওর মা তো রিকশাওয়ালি!”
সে মাথা নিচু করে থাকত, মায়ের চোখে চোখ রাখত না।
কিন্তু একদিন, হঠাৎ এক বন্ধু বলল,
“তোর মা তো আসল হিরো রে, তোর জন্য এত কিছু করছে!”
সেদিন সে প্রথম বুঝতে শেখে —
তার মা কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনি একজন শিক্ষক —
জীবনের প্রতিটি ক্লাসের শিক্ষক।
সময়ের সাথে সাথে,
সে দেখে — যেদিন তার বই কিনে দেওয়ার টাকা ছিল না,
সেদিন মা আরও বেশি প্যাডেল চালিয়েছে।
সে বুঝে যায়,
কোনো ক্লাসরুমের লেকচার, কোনো কলেজের ডিগ্রি
তার মায়ের জীবনের পাঠের চেয়ে বড় নয়।
কখনো রাগ করে, কখনো লজ্জা পায়, কিন্তু একসময় বুঝে যায় — মা মানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা
ক্লাস সেভেনে থাকতে সে একদিন মাকে বলেছিল,
“তুমি আর স্কুলে আসবে না, আমি নিজেই চলে যাবো।”
সে বুঝত না, লজ্জা আর অপমানের পার্থক্য কী।
কিন্তু যখন এসএসসি পাস করে হলের মঞ্চে উঠল,
সার্টিফিকেট হাতে দাঁড়িয়ে বলল—
“এই কাগজের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যে মানুষের — তিনি আজ হলের বাইরের রাস্তায়, রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।”
সেই মুহূর্তে, সব লজ্জা, সব ভুল বোঝাবুঝি গলে গিয়ে চোখের জলে পরিণত হয়।
সে বুঝে যায় — তার মায়ের চালানো রিকশাই তাকে জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস করিয়েছে।
মা কোনো বইয়ের লেখক নন,
তবু তার প্রতিটি পরিশ্রম, প্রতিটি নিরব রাত ছিল সন্তানের কাছে
“একটি জীবন্ত অধ্যায়।”
আমাদের সমাজে এমন মায়েরা কেন চুপচাপ থেকে যান?
সমাজ কীভাবে দেখে এই ধরনের মায়েদের
আমরা সভ্য সমাজে বাস করি —
কিন্তু সেই সমাজে একজন মা যদি রিকশা চালান, তাহলে আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি না, আলোচনার বিষয় বানিয়ে ফেলি।
“নারী হয়ে এসব কাজ…”,
“স্বামী নেই বুঝি?”,
“লোক দেখানোর জন্য করছে” —
এই কথাগুলো তাকে একেকটা ইটের মতো আঘাত করে।
অথচ আমরা কেউ বলি না —
“এই নারী একজন বীর”
“তিনি নিজের সন্তানকে রক্ষা করছেন দারিদ্র্যের থাবা থেকে”
আমাদের চোখ কেবল তখনই খুলে যায়,
যখন কোনো ইউটিউব ভিডিও বানায়, ভাইরাল হয়,
তখন আমরা বলি — “অসাধারণ!”
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই মায়েরা কি শুধুই ক্যামেরার জন্য অসাধারণ?
না কি তারা প্রতিদিন অসাধারণ — কেবল আমরা দেখতাম না?
কেন এমন গল্পগুলো সামনে আসে না
কারণ এসব গল্পে চটকদার কিছু নেই —
না আছে নায়কের একশন দৃশ্য,
না আছে বিদেশি বাড়ি, বিলাসী গাড়ি।
এখানে আছে কেবল
একজন মা, যার ঘামের প্রতিটি বিন্দুতে লেখা সন্তানের ভবিষ্যৎ।
এমন গল্প টিভিতে চলে না — কারণ এসব গল্প চুপচাপ, নিঃশব্দ, বিজ্ঞাপনের মতন ঝকঝকে নয়।
কিন্তু যারা বুঝতে পারে, তারা কাঁদে।
তারা জানে — পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব মায়েরও গল্প আছে,
আর সেই গল্পের নামই হতে পারে “বাঁচার আরেক নাম: মা”।
এসব গল্প সামনে আসে না,
কারণ আমরা দেখিনা — আমরা শুধু “দেখাতে” ভালোবাসি।
আমার মা যদি এমন হতো — আমরা সবাই যদি এমন হতে পারতাম
পাঠকের মন ছুঁয়ে দেওয়া অংশ
কল্পনা করো, তুমি স্কুল থেকে ফিরছো —
আর তোমার মা ভেজা কাপড়ে, ধুলা-মাখা হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছেন।
তিনি বলেন না, “কেমন গেল পরীক্ষা?”
তিনি শুধু বলেন,
“তোমার জন্য আজ একটু বাড়তি রিকশা চালালাম, নতুন পেনটা এনেছি।”
এখন নিজের জীবনের দিকে তাকাও —
তুমি কি কখনও এমন মায়ের গল্প নিজের চারপাশে দেখেছো?
তুমি কি কখনও বুঝেছো,
একজন মা কতটা চুপচাপ ভালোবাসতে পারে —
যেখানে শব্দের দরকার হয় না, শুধু উপস্থিতিটাই সবকিছু।
আমাদের অনেকেই হয়তো এমন মায়ের সন্তান নই —
তবুও এই গল্পটা আমাদের শেখায়
মা হওয়া মানে শুধু সন্তান জন্ম দেওয়া নয় —
মা হওয়া মানে নিজেকে প্রতিদিন বিলিয়ে দেওয়া, আর একটা ভবিষ্যতের ভিত গড়ে দেওয়া।
একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া — তুমি কি কখনো এমন ভালোবাসা চিনেছো?
তুমি কি কখনও এমন ভালোবাসা অনুভব করেছো,
যেখানে কাঁধে হাত পড়লে পৃথিবী নরম মনে হয়?
এমন ভালোবাসা,
যেখানে মা ভাত কম খায়, যাতে তুমি একবাটি বেশি নিতে পারো?
এমন ভালোবাসা,
যেখানে প্রশ্ন করা হয় না, কিন্তু চোখের দিকে তাকিয়ে সব উত্তর দেওয়া হয়?
তুমি কি এমন মা পেয়েছো,
যার নীরবতা ছিল তোমার জীবনের সবচেয়ে জোরালো অনুপ্রেরণা?
যদি না পেয়ে থাকো, তাহলে অন্তত চেনো কি এমন কাউকে?
এখন প্রশ্নটা তোমার ভেতরে পড়ে থাকুক…
আর উত্তরটা আসুক চোখ ভিজিয়ে।
পাঠকদের মনে জাগা কিছু সাধারণ প্রশ্ন
এই মা কোথায় থাকেন?
এই মা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি ছোট শহরে থাকেন, যেটির নাম আমরা গোপন রেখেছি তাঁর সম্মানের জন্য।
তিনি একটি ভাঙা ঘরে থাকেন — কিন্তু তাঁর স্বপ্ন আজও অটুট।
তার সন্তান এখন কী করে?
তাঁর ছেলে বর্তমানে কলেজে পড়ছে — রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক স্তরে।
স্কলারশিপ পেতে না পারলেও, মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে সে এখনও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।
কত বছর ধরে তিনি রিকশা চালাচ্ছেন?
প্রায় ৯ বছর ধরে তিনি রিকশা চালাচ্ছেন।
প্রথমে সমাজের চোখ ছিল বিষাক্ত, পরে তাঁর নিষ্ঠা সেই দৃষ্টিকে বদলে দেয়।
সমাজ বা সরকার কোনো সাহায্য করেছে কি?
না, সরকারিভাবে কোনো সহায়তা মেলেনি এখনো পর্যন্ত।
কিছু স্থানীয় মানুষ একবার কিছু বইপত্র দিয়েছিলেন,
কিন্তু মায়ের যাত্রাপথে তিনি সবচেয়ে বড় ভরসা মনে করেন “নিজের ইচ্ছাশক্তিকে।”
এই গল্প কি সত্য?
হ্যাঁ, এই গল্প সত্য — যদিও আমরা নাম, স্থান কিছুটা পরিবর্তন করেছি গোপনীয়তার কারণে।
তবে অনুভবগুলো এক ফোঁটা কম নয় — বরং আরও বেশি বাস্তব, আরও বেশি তীব্র।
শেষ কথা: মা মানে শুধু জন্মদাত্রী নয় — তিনি একজন যোদ্ধা
এই মায়ের গল্পটা হয়তো ফেসবুকে ভাইরাল হয়নি।
টকশোতেও তিনি অতিথি হননি।
কিন্তু প্রতিদিন যখন সূর্য ওঠে, তিনি সেই রোদের নিচে প্যাডেল চালিয়ে যান —
কারণ তাঁর সন্তানের ভবিষ্যৎ তার পেছনেই বসে আছে।
আমরা মা বলতে বুঝি রান্না, শাড়ি, কোলে ঘুমানো —
কিন্তু এই মা শিখিয়ে দেন,
“মা মানে শুধুই জন্মদাত্রী নয় — মা মানে একজন যোদ্ধা, একজন স্থপতি, একজন স্বপ্নের ছায়া।”
আমরা যাদের অনুপ্রেরণার গল্প বলে থাকি,
তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো মঞ্চে উঠে বক্তব্য রাখেন।
এই মা কেউ না বললেও,
প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করেন — নিঃশব্দে, সাহসে, ভালোবাসায়।
নিজস্ব ভাষায় অশ্রুসিক্ত সমাপ্তি
যে মা রিকশা চালিয়ে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেয়,
তিনি শুধু মা নন — তিনিই দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।