মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল ও কিতাব পাঠিয়েছেন। এই ধারায় সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ কিতাব হলো কুরআন কেন নাজিল হয়েছে—এই প্রশ্নটি প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে থাকা জরুরি। এর উত্তরটি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং মানবজীবনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা এবং চিরন্তন শান্তির বার্তা বয়ে আনে। সৃষ্টিকর্তা তাঁর বান্দাদের জন্য কেন এই মহিমান্বিত গ্রন্থটি পাঠালেন, তার মূল কারণ ও উদ্দেশ্য গভীরভাবে বোঝা আমাদের ঈমানের দাবি।
কুরআন কেন নাজিল হয়েছে: সংক্ষিপ্ত সরাসরি উত্তর
কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য হলো মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়া (হিদায়াত), সত্য-মিথ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী (ফুরকান) হিসেবে কাজ করা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল (lawful) ও হারামের (unlawful) বিধান নিশ্চিত করা এবং পরকালীন জীবন (আখিরাত) সম্পর্কে চূড়ান্ত সতর্কতা ও সুসংবাদ প্রদান করা। এটি কেবল একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, বরং এটি একটি চিরন্তন সংবিধান, যা মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদের (তাওহীদ) পথে পরিচালিত করে।
বিস্তারিত ব্যাখ্যা
মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য কুরআন নাজিল
কুরআন মাজিদ হলো মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত শ্রেষ্ঠতম হিদায়াত বা পথনির্দেশিকা। মানুষ যখন সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছিল, তখন আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে এই কিতাব নাজিল করেন যেন তারা সরল পথে (সিরাত-আল-মুস্তাকীম) ফিরে আসতে পারে। এটি জীবন পরিচালনার জন্য এমন এক পূর্ণাঙ্গ ম্যানুয়াল (manual) যা মানুষকে পার্থিব জীবনের সাফল্য ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করার শিক্ষা দেয়। এই কারণেই আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সৎ পথের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।” (সূরা আল-বাকারাহ 2:185)
এই আয়াত স্পষ্ট করে যে, কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সেই পথে নিয়ে যাওয়া, যা তারা সূরা আল-ফাতিহা-তে প্রার্থনা করে থাকে:
“আমাদেরকে সরল পথ দেখান, তাদের পথ—যাদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন; তাদের পথ নয়, যাদের ওপর আপনার ক্রোধ আপতিত হয়েছে, এবং যারা পথভ্রষ্ট।” (সূরা আল-ফাতিহা 1:6–7)
পূর্ববর্তী বিকৃত কিতাবের পরিবর্তে চূড়ান্ত হিদায়াত হিসেবে
আল্লাহর পক্ষ থেকে এর আগেও বহু কিতাব নাজিল হয়েছিল, যেমন—তাওরাত (Torah), যাবুর (Psalms) ও ইঞ্জিল (Gospel)। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেগুলোর মূল টেক্সট (text) ও শিক্ষা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এই বিকৃতির কারণে মানবজাতির জন্য একটি অভ্রান্ত, সুরক্ষিত ও চূড়ান্ত পথনির্দেশিকার প্রয়োজন ছিল। কুরআনের কারণ হলো এটিই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সেই চূড়ান্ত বিধান, যা পূর্বের সমস্ত কিতাবকে সত্যায়ন করে এবং সেগুলোর ওপর সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে।
কুরআন মাজিদকে ‘মুহাইমিন’ (Muhaymin) বা সংরক্ষক বলা হয়েছে, কারণ এটি পূর্বের কিতাবগুলোর সঠিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করেছে এবং তাদের ভুল ব্যাখ্যা ও সংযোজন থেকে মুক্ত। আল্লাহ তা’আলা এই বিষয়ে বলেন:
“আর আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি সত্যতার সাথে, যা এর পূর্বের কিতাবসমূহকে সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর ওপর তদারককারী (মুহাইমিন)।” (সূরা আল-মায়েদাহ 5:48)
এভাবে আল্লাহর কিতাব কুরআন নিশ্চিত করেছে যেন মানুষের কাছে তার সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আসা বার্তায় কোনো ধরনের বিকৃতি বা সংশয় না থাকে।
হালাল–হারাম ও নৈতিক বিধান স্পষ্ট করার জন্য
মানবসমাজকে বিশৃঙ্খলা, অন্যায় (injustice) ও নৈতিক অবক্ষয় (moral degradation) থেকে রক্ষা করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইনি ও নৈতিক কাঠামোর প্রয়োজন। কুরআন এই কাঠামো সরবরাহ করে, যেখানে মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তাকে হালাল এবং যা ক্ষতিকর তাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক লেনদেন (transaction) ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যন্ত, কুরআনে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।
এই বিধানগুলো মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির (ফিতরাত) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সমাজকে ন্যায় ও শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার ভিত্তি তৈরি করে। কুরআন নাজিলের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো:
“আর আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি, যেন আপনি তাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন সেসব বিষয়, যাতে তারা মতবিরোধ করে, আর এটি মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ।” (সূরা আন-নাহল 16:89)
কুরআন নাজিল হয়েছে যেন কোনো মানুষ তার নিজের খেয়াল-খুশি মতো জীবন পরিচালনা না করে, বরং আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী একটি ভারসাম্যপূর্ণ (balanced) ও দায়িত্বশীল জীবন যাপন করতে পারে।
আখিরাত সম্পর্কে সতর্কতা ও সুসংবাদ দেওয়ার জন্য
মানুষের জীবন শুধু এই পৃথিবী পর্যন্ত সীমিত নয়; বরং পরকাল (আখিরাত) হলো আসল ও চিরন্তন ঠিকানা। কুরআন বারবার এই সত্যটি স্মরণ করিয়ে দেয়। কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে এই বিষয়ে সতর্ক করা যে, প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, এবং যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য সুসংবাদ (জান্নাত) রয়েছে, আর যারা অস্বীকার করবে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন পরিণাম (জাহান্নাম)।
কুরআন মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে তারা যেন তাদের চূড়ান্ত গন্তব্যের জন্য প্রস্তুত থাকে। যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“আমি তাকে পথ দেখিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো অকৃতজ্ঞ।” (সূরা আল-ইনসান 76:3)
এবং
“আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? বুদ্ধিমান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা আজ-যুমার 39:9)
এই শিক্ষা মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে এবং তাদের পার্থিব জীবনের লক্ষ্যকে পরকালীন সাফল্যের সাথে যুক্ত করে।
বাস্তব জীবনে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্যের প্রয়োগ
কুরআন কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর উদ্দেশ্য মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা।
- ব্যক্তিগত জীবন: কুরআন মানুষকে সৎ চরিত্র, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা এবং পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণ করতে শেখায়। এটি একজন ব্যক্তির নৈতিক মানদণ্ড (moral standard) উন্নত করে এবং তাকে আত্মনিয়ন্ত্রণে (self-control) সাহায্য করে।
- সামাজিক ন্যায়বিচার: কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, দুর্বলদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং ঘুষ, সুদ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক। এর লক্ষ্য একটি সহানুভূতিশীল (compassionate) ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তৈরি করা।
- রাষ্ট্র ও নৈতিক কাঠামো: কুরআন রাষ্ট্রের প্রধানদের আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করার নির্দেশ দেয়। এটি আইনের শাসন, পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ (শুরা) এবং জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি প্রণয়ন করে।
ভুল ধারণা ও সতর্কতা
কুরআন সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে, যা স্পষ্ট করা জরুরি।
- কুরআন শুধু আরবদের জন্য—এই ধারণার ভুল: এটি একটি বিশ্বজনীন (universal) কিতাব, যা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানবজাতির জন্য নাজিল হয়েছে। এর ভাষা আরবি হলেও এর বার্তা সমস্ত ভাষার মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
- কুরআন বিজ্ঞান বই—এমন অতিরঞ্জন: কুরআন বিজ্ঞান (science), ইতিহাস, বা ভূগোল শেখানোর জন্য নাজিল হয়নি। এটি মূলত হিদায়াতের কিতাব। যদিও কুরআনে এমন কিছু আয়াত রয়েছে যা আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তবে এটিকে কেবল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা ভুল।
- কুরআনের আয়াত নিজের মত ব্যাখ্যা করার বিপদ: কুরআন বোঝার জন্য এর ভাষা, প্রেক্ষাপট (context) এবং তাফসীর (explanation) জানা জরুরি। নিজের খেয়াল-খুশি বা সীমিত জ্ঞান নিয়ে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা দেওয়া গুরুতর ধর্মীয় ভুলের দিকে নিয়ে যেতে পারে। উলামায়ে কেরাম (scholars) এবং তাফসীরের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ অনুসরণ করা আবশ্যক।
উপসংহার
কুরআন কেন নাজিল হয়েছে—এর মূল কারণ ও উদ্দেশ্য হলো মানবজাতিকে আল্লাহর পরিচয় দেওয়া, জীবনে সঠিক পথ দেখানো এবং পরকালের জন্য প্রস্তুত করা। এটি বিশ্বাসীদের জন্য আলো, অসুস্থ হৃদয়ের জন্য নিরাময় এবং জীবনের প্রতিটি সমস্যার জন্য সমাধান নিয়ে এসেছে। কুরআন নাজিলের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, তা কেবল এর অনুসরণ ও এর শিক্ষাকে জীবনের সর্বস্তরে প্রয়োগ করার মাধ্যমেই প্রতিফলিত হতে পারে। কুরআন হলো সেই আমানত (trust), যার মাধ্যমে মানবজাতির ইহকাল ও পরকালের সাফল্য নির্ধারিত হবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
কুরআন কি শুধু মুসলমানদের জন্য নাজিল হয়েছে?
না, কুরআন সমস্ত মানবজাতির জন্য নাজিল হয়েছে। যদিও শুধু মুসলিমরাই এর অনুসরণ করে, তবে এর বার্তা ও নৈতিক শিক্ষা বিশ্বজনীন।
কুরআন ধীরে ধীরে কেন নাজিল হয়েছে?
মানুষের গ্রহণ ও বোঝার সুবিধার জন্য, তাৎক্ষণিক ঘটনার ভিত্তিতে বিধান দেওয়ার জন্য, এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্তরকে শক্তিশালী করার জন্য এটি ২৩ বছর ধরে ধীরে ধীরে নাজিল হয়েছে।
কুরআনের উদ্দেশ্য কি শুধু ইবাদত শেখানো?
ইবাদত (worship) একটি প্রধান অংশ হলেও, কুরআনের উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক। এটি জীবনধারা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি—সবকিছুর জন্য দিকনির্দেশনা দেয়।
কুরআন কি বর্তমান যুগেও প্রযোজ্য?
হ্যাঁ, কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত সব যুগের জন্য চূড়ান্ত ও চিরন্তনভাবে প্রযোজ্য (relevant) কিতাব। এর বিধান ও বার্তা সময়ের সাথে অপ্রাসঙ্গিক হয় না।
কুরআন অনুসরণ না করলে কী ক্ষতি?
কুরআন অনুসরণ না করলে ব্যক্তি ইহকালে আল্লাহর হিদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে এবং পরকালে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কুরআন কি আগের কিতাবগুলো বাতিল করেছে?
কুরআন আগের কিতাবগুলোর মূল নীতিকে সত্যায়ন (confirm) করেছে, তবে তাদের বিধানের ওপর একটি চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ আইন হিসেবে এসেছে। এটি আসার পর অন্য কিতাবের বিধান মানা বাতিল হয়ে গেছে।
রেফারেন্স
এই আর্টিকেলটির ধর্মীয় তথ্য এবং ব্যাখ্যার ভিত্তি হলো:
- কুরআন মাজিদ: সূরা আল-বাকারাহ (2:185), সূরা আল-ফাতিহা (1:6–7), সূরা আল-মায়েদাহ (5:48), সূরা আন-নাহল (16:89), সূরা আল-ইনসান (76:3), সূরা আজ-যুমার (39:9)।
- তাফসীর ও আলেমদের মত: ইমাম ইবনে কাছীর (ইবনে কাছীরের তাফসীর), এবং সমসাময়িক উলামাদের (scholars) সাধারণ ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
Your comment will appear immediately after submission.