ইসলাম ধর্মে মানুষের সৃষ্টি, বিশেষ করে নারী ও পুরুষের উৎপত্তি, একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। সাধারণ মানুষের মনে প্রায়শই প্রশ্ন জাগে যে, কোরআন বা হাদিসে নারীর সৃষ্টি সম্পর্কে কী বলা হয়েছে, বিশেষ করে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে যে, নারীকে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা কোরআন ও হাদিসের আলোকে এই প্রচলিত ধারণার সত্যতা এবং এর পেছনের ব্যাখ্যাগুলো আলোচনা করব, যাতে এই বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা লাভ করা যায়।
কোরআনে কি বলা আছে যে স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে স্ত্রী সৃষ্টি হয়েছে?
ইসলাম ধর্মে, নারী সৃষ্টির বিষয়টি প্রায়শই আদম (আ.)-এর পাঁজরের হাড় থেকে বিবি হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনা দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। তবে, এই বিষয়ে কোরআনে সরাসরি এবং সুস্পষ্ট কোনো আয়াত নেই যা সুনির্দিষ্টভাবে “স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে স্ত্রী সৃষ্টি হয়েছে” বলে উল্লেখ করে।
কোরআনের নির্দেশনা:
কোরআনুল কারিমের সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই ব্যক্তি থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দুজন থেকে বহু নর ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।
(কোরআন, ৪:১)
এই আয়াতটি ইঙ্গিত করে যে, সকল মানবজাতিকে একই উৎস (আদম আ.) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেই উৎস থেকেই তাঁর সঙ্গিনী (হাওয়া আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়নি।
হাদিসের ব্যাখ্যা:
ইসলামী জ্ঞানচর্চায়, এই আয়াতের ব্যাখ্যা এবং নারীর সৃষ্টি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য হাদিস শরিফে পাওয়া যায়। একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:”নারীকে পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। সে তোমার জন্য কখনোই সোজা হবে না। তার দ্বারা কাজ আদায় করতে হলে এই বাঁকা অবস্থায়ই আদায় করতে হবে। এটি সোজা করতে গেলে ভেঙে যাবে। ভাঙার অর্থ হলো তালাক ঘটে যাওয়া।
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-১৪৬৮)
এই হাদিসটিতে “পাঁজরের হাড়” থেকে নারীর সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, এবং অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিত মনে করেন যে এটি হযরত আদম (আ.) থেকে বিবি হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টির দিকেই ইঙ্গিত করে। এটি একটি রূপক অর্থে নারীর স্বভাব এবং তার প্রতি সদয় আচরণের গুরুত্ব বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। এই হাদিসের মাধ্যমে সমস্ত নারীকে তাদের স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এমনটি বোঝানো হয়নি, বরং আদম ও হাওয়ার সৃষ্টির উপমা হিসেবে এর ব্যবহার করা হয়েছে।
সারসংক্ষেপ:
সুতরাং, কোরআনে সরাসরি “স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে স্ত্রী সৃষ্টি” এমন সুস্পষ্ট বর্ণনা না থাকলেও, হাদিসে এই ধারণার উল্লেখ রয়েছে যা মূলত প্রথম মানব আদম (আ.) থেকে বিবি হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি ইসলামী বিশ্বাসে একটি বহুল প্রচলিত ব্যাখ্যা।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
কোরআনে কি সরাসরি বলা হয়েছে যে, নারী পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে?
না, কোরআনে সরাসরি এমন কোনো আয়াত নেই যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, নারী পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে। কোরআনের সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষকে ‘এক ব্যক্তি’ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেখান থেকেই তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে কোরআনে উল্লেখ করা হয়নি।
তাহলে “পাঁজরের হাড় থেকে নারী সৃষ্টি” – এই ধারণাটি কোথা থেকে এসেছে?
এই ধারণাটি মূলত হাদিস শরিফ থেকে এসেছে। সহীহ মুসলিমের একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “নারীকে পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।” অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিত এই হাদিসকে হযরত আদম (আ.) থেকে বিবি হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টির দিকে ইঙ্গিত বলে ব্যাখ্যা করেন।
হাদিসে “পাঁজরের হাড়” দ্বারা সৃষ্টির কথা বলার তাৎপর্য কী?
হাদিসে “পাঁজরের হাড়” দ্বারা সৃষ্টির কথা বলাটি সাধারণত দুটি অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়:
সৃষ্টিগত দিক: এটি প্রথম মানব আদম (আ.) থেকে বিবি হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টির একটি রূপক বা আক্ষরিক বর্ণনা হতে পারে।
রূপক বা উপদেশমূলক দিক: এটি নারীর স্বভাবজাত কিছু বৈশিষ্ট্য (যেমন: কোমলতা, আবেগপ্রবণতা) এবং তাদের প্রতি পুরুষের সদয় আচরণের গুরুত্ব বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। হাদিসে এর পরের অংশে বলা হয়েছে, “সে তোমার জন্য কখনোই সোজা হবে না। তার দ্বারা কাজ আদায় করতে হলে এই বাঁকা অবস্থায়ই আদায় করতে হবে। এটি সোজা করতে গেলে ভেঙে যাবে। ভাঙার অর্থ হলো তালাক ঘটে যাওয়া।
এই বর্ণনা কি সমস্ত নারীর জন্য প্রযোজ্য, নাকি শুধু বিবি হাওয়া (আ.)-এর জন্য?
এই বর্ণনাটি মূলত প্রথম নারী বিবি হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত, যিনি আদম (আ.) থেকে সৃষ্ট। এর দ্বারা সমস্ত নারীকে তাদের স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এমনটি বোঝানো হয়নি। বরং, এটি সৃষ্টির একটি মৌলিক দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
নারীর সৃষ্টি নিয়ে ইসলামী বিশ্বাসে কি ভিন্ন মতবাদ আছে?
নারীর সৃষ্টি সম্পর্কে মূল বিশ্বাস (কোরআন ও হাদিসের আলোকে) সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে, “পাঁজরের হাড়” থেকে সৃষ্টির প্রক্রিয়াটির আক্ষরিক নাকি রূপক ব্যাখ্যা, তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে সামান্য মতভেদ রয়েছে। তবে, মূল বিষয়ে (অর্থাৎ নারীকে পুরুষ জাতি থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে, কোনো বিতর্ক নেই।