মব জাস্টিস বনাম আদালতের রায়: বিচারহীনতার পথে সমাজ?

প্রকাশিত হয়েছে: 22 মে, 2025 দ্বারা Taibur Rahman
✅ বিশেষজ্ঞ দ্বারা অনুমোদিত
5/5 - (1 vote)

ভূমিকা

মানুষ সভ্য হয়েছে ন্যায়বিচারের জন্য। একসময় জংলি সমাজে শক্তিশালীই ছিল বিচারক, কিন্তু সমাজ যতই উন্নত হয়েছে, ততই আমরা ন্যায়, আইন এবং প্রতিষ্ঠিত আদালতব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে শিখেছি। কিন্তু বর্তমান সমাজে একটা নতুন ভয়ংকর বাস্তবতা আমাদের সামনে দেখা দিচ্ছে — মব জাস্টিস। যখন জনতার চাপেই আদালতের রায় প্রভাবিত হতে থাকে, তখন প্রশ্ন ওঠে — “মব তৈরি করে যদি হাইকোর্টের রায় আদায় করা যায়, তাহলে হাইকোর্টের দরকার কী?”

এই প্রশ্নটি শুধু ক্ষোভ বা হতাশা প্রকাশ করে না, এটি রাষ্ট্র, সমাজ ও আইনব্যবস্থার জন্য একটি গভীর আত্মবিশ্লেষণের অনুরোধ বহন করে।


মব জাস্টিস কী?

“মব জাস্টিস” বলতে বোঝায় — জনতার আবেগে পরিচালিত, আইনবহির্ভূত একটি আচরণ যেখানে জনগণের উত্তেজিত একটি দল নিজেরাই অপরাধী নির্ধারণ করে শাস্তি দিতে চায়। এতে বিচারপ্রক্রিয়া, তথ্য-প্রমাণ, যুক্তি কিংবা আইনের কোনো স্থান থাকে না।

এই বিচার হয়:

  • হঠাৎ আবেগে,
  • গুজবের ভিত্তিতে,
  • কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনায়,
  • এবং প্রায়শই — একপাক্ষিক ও হিংসাত্মক।

হাইকোর্ট বা বিচারব্যবস্থার উদ্দেশ্য কী?

একটি সুসভ্য রাষ্ট্রে আদালত মানে:

  • নিরপেক্ষ বিচার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান,
  • যেখানে তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করা হয়,
  • যেখানে উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনা হয়,
  • এবং যেখানে বিচার হয় আইনের ভাষায়, আবেগে নয়

হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট শুধু বিচার দেয় না — তারা আইনের দৃষ্টান্ত তৈরি করে, ভবিষ্যতের জন্য পথনির্দেশনা দেয়, এবং রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ স্তরের দায়িত্ব পালন করে।


তাহলে মবের হাতে বিচার গেলে কী হয়?

যদি মব-ই বিচার করতে চায়, তবে নিম্নলিখিত বিপজ্জনক পরিণতিগুলো ঘটে:

. নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়

একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যিই অপরাধী কিনা — সেটা না জেনে মব তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। এতে অনেক নিরপরাধ মানুষ মার খায়, হয়তো প্রাণও হারায়।

. আইন অকার্যকর হয়ে পড়ে

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় আদালতের মাধ্যমে। কিন্তু যদি বিচার মব করে, তাহলে আদালত শুধুই প্রতীকী থেকে যায়।

. গুজব অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ে

একটি ভুল খবর মবকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে। যেমন — ফেসবুকে কোনো পোস্ট দেখে ধর্মীয় উগ্রতা ছড়িয়ে কারো বিরুদ্ধে হামলা।

. সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে

আজ যদি একজন মবের শিকার হয়, কাল যে কেউ হতে পারে। এতে সমাজে নিরাপত্তার অভাব তৈরি হয়।

. রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের আশঙ্কা

অনেক সময় মব তৈরি করে কিছু গোষ্ঠী নিজের রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেয়। এতে বিচার তো হয় না, বরং বিভাজন তৈরি হয়।


বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা কি ন্যায়সঙ্গত?

এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অনেক সময় দেখা যায় — কোনো আলোচিত মামলায় জনগণ আন্দোলন করছে, মিডিয়া চাপে রাখছে, এবং শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় সেই দিকে হেলে যাচ্ছে।

এখানে একটি ভয়ংকর দিক হচ্ছে — আদালতের রায় যদি জনতার আবেগে প্রভাবিত হয়, তবে সেখানে আইন যুক্তির ভূমিকা কোথায়? তাহলে তো বিচার হবে না, হবে জনতার ইচ্ছার বাস্তবায়ন, যেটা আইন নয় — পপুলার জাজমেন্ট।


তাহলে আদালতের দরকার কী?

এই প্রশ্নের উত্তর খুবই পরিষ্কার এবং গুরুত্বপূর্ণ। আদালত মানে নিয়ম, শৃঙ্খলা, যুক্তি ন্যায়বিচার।
মব মানে — আবেগ, গুজব, ও হঠকারী সিদ্ধান্ত।

আদালত দরকার কারণ:

  • আমরা আবেগ দিয়ে নয়, প্রমাণ দিয়ে বিচার চাই।
  • আমরা বিচারের নামে প্রতিশোধ নয়, সত্য চায়।
  • আমরা চিৎকারে নয়, যুক্তিতে বিশ্বাসী।

করণীয়

রাষ্ট্রের দায়িত্ব:

  • মব জাস্টিস প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
  • বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখতে হবে।
  • জনগণকে সচেতন করতে হবে — আইন অমান্য করলে তার শাস্তি আছে।

জনগণের দায়িত্ব:

  • গুজবে কান না দিয়ে আইন ও আদালতের প্রতি আস্থা রাখা।
  • উত্তেজনায় না ভেসে প্রমাণ ও তথ্যের ভিত্তিতে বিচার দাবি করা।
  • আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী না ভাবা।

উপসংহার

“মব তৈরি করে যদি হাইকোর্টের রায় আদায় করা যায়, তাহলে হাইকোর্টের দরকার কী?” — এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমাজের একটি সংকটচিহ্ন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ন্যায়বিচার কখনোই চিৎকার করে প্রতিষ্ঠিত হয় না, সেটা প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তি, প্রমাণ এবং আইনের মাধ্যমে।

যদি মবই বিচার করে, তাহলে আমরা আবার সেই আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি — যেখানে শক্তির আধিপত্য ছিল, ন্যায়ের নয়।

আমাদের বেছে নিতে হবেআমরা কি আইনের শাসনের দেশ চাই, নাকি হট্টগোলের রাজত্ব?

Avatar of Taibur Rahman

Taibur Rahman

আমি তৈয়বুর রহমান। লেখা আমার অভ্যাস নয়, এটা আমার প্রকাশের মাধ্যম। নাজিবুল ডটকমে আমি এমন কন্টেন্ট তৈরি করি যা শুধু তথ্য দেয় না, চিন্তার খোরাকও যোগায়। লক্ষ্য একটাই – জটিল বিষয়কে সহজ করে পাঠকের মনে গেঁথে যাওয়া।

আমার সব আর্টিকেল

মন্তব্য করুন