হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এক রাত—যার পরশে মুমিনের পাপ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং আমলনামায় যোগ হয় হাজার মাসের সাওয়াব। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মহিমান্বিত এই রাতটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং লাইলাতুল কদর কী, তা জানা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। রমজান মাসের শেষ দশকে লুকানো এই রহমতের রাতটি আমাদের পরকালীন পাথেয় সংগ্রহের শ্রেষ্ঠ সুযোগ।
লাইলাতুল কদর কী?
লাইলাতুল কদর বা শবে কদর হলো রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে এমন একটি রাত, যাতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। ‘লাইলাতুল কদর’ (shabe-qadr) শব্দের অর্থ হলো সম্মানের রাত বা মহিমান্বিত রাত। মহান আল্লাহ তাআলা এই একটি রাতের ইবাদতকে এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। এটি মূলত ক্ষমা, রহমত এবং ভাগ্য নির্ধারণের রাত।
বিস্তারিত ব্যাখ্যা: লাইলাতুল কদরের মাহাত্ম্য
লাইলাতুল কদরের অর্থ ও পরিচয়
ইসলামিক পরিভাষায় ‘লাইলাতুল কদর’ মানে মহিমান্বিত রাত। এই রাতের শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ হলো মানবজাতির হিদায়াতের আলোকবর্তিকা ‘আল-কুরআন’ এই রাতেই লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে নাজিল হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
“নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। আপনি কি জানেন কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সূরা আল-কদর, ৯৭:১–৩) মুফাসসিরগণের মতে, এই রাতে ইবাদত করলে অন্তত ৮৩ বছর ৪ মাস ইবাদত করার সমপরিমাণ সওয়াব অর্জিত হয়। এটি উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ উপহার।
কেন লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম
লাইলাতুল কদরের শ্রেষ্ঠত্ব কেবল কুরআন নাজিলের কারণে নয়, বরং এই রাতে আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়। সূরা আল-কদরের ৩ নম্বর আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী উম্মতরা দীর্ঘ হায়াত পেত, কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীর হায়াত কম। তাই আল্লাহ এই এক রাতের ইবাদতকে হাজার মাসের চেয়েও বাড়িয়ে দিয়েছেন যাতে মুমিনরা অল্প সময়ে বেশি নেকি অর্জন করতে পারে। এটি বান্দার জন্য আল্লাহর সীমাহীন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
লাইলাতুল কদর কখন হয়—রমজানের কোন রাতে?
লাইলাতুল কদর ঠিক কত তারিখে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানানো হয়নি যাতে মুমিনরা পুরো শেষ দশক ইবাদতে মগ্ন থাকে। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯) একে অনুসন্ধান করতে। সহিহ বুখারির (২০১৭) বর্ণনা অনুযায়ী, নবীজি (সা.) বলেছেন:
“তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।” অনেকে কেবল ২৭শে রমজানকে নির্দিষ্ট মনে করেন, তবে ওলামাদের মতে এটি যেকোনো বিজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এই রাতে ফেরেশতাদের অবতরণ ও শান্তি
কদরের রাতে জিবরাঈল (আ.)-সহ অসংখ্য ফেরেশতা পৃথিবীতে নেমে আসেন। তারা মুমিন বান্দাদের ইবাদত দেখেন এবং তাদের জন্য শান্তির দোয়া করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
“সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ (জিবরাঈল) অবতীর্ণ হন তাদের পালনকর্তার নির্দেশে সব বিষয় নিয়ে। এটা শান্তি, যা ফজর উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” (সূরা আল-কদর, ৯৭:৪–৫) অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত পুরো সময়টিই রহমত ও শান্তিতে পরিপূর্ণ থাকে।
লাইলাতুল কদরে কী কী আমল করা উচিত
লাইলাতুল কদরের আমল (lailatul-qadrer-amol) হওয়া উচিত একনিষ্ঠ ও ইখলাসের সাথে। এই রাতে বিশেষ কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, তবে নিচের আমলগুলো অত্যন্ত ফলপ্রসূ:
- নফল নামাজ ও তাহাজ্জুদ: কমপক্ষে ৮ রাকাত বা তার বেশি নফল নামাজ পড়া। প্রতিটি সিজদাহ দীর্ঘ করা এবং কান্নাকাটি করা।
- কুরআন তিলাওয়াত: অর্থসহ কুরআন পাঠ করা এই রাতের শ্রেষ্ঠ আমল।
- জিকির ও ইস্তেগফার: সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং বেশি বেশি আস্তাগফিরুল্লাহ পড়া।
- বিশেষ দোয়া: মা আয়েশা (রা.) নবীজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আল্লাহর রাসুল! আমি যদি কদর খুঁজে পাই তবে কী পড়ব?” নবীজি (সা.) এই দোয়াটি শিখিয়েছিলেন (তিরমিজি: ৩৫১৩):
“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুওউন তুহিব্বুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নি” (হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করুন।)
সতর্কতা ও ভুল ধারণা
- নির্দিষ্ট রাত নিশ্চিত মনে করা: কেবল ২৭শে রমজানকে কদর মনে করে বাকি রাতগুলো ইবাদত না করা একটি বড় ভুল।
- শুধুই জাগ্রত থাকা: সারারাত আড্ডা দিয়ে বা গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া কিন্তু নামাজ বা তিলাওয়াত না করা কদরের শিক্ষা নয়।
- ভিত্তিহীন আমল: নির্দিষ্ট সুরা দিয়ে এত রাকাত নামাজ পড়তে হবে—এমন কোনো বিধান হাদিসে নেই। নফল নামাজ যেকোনো সুরা দিয়ে পড়া যায়।
- আতশবাজি বা হইচই: কদরের রাত হলো নিভৃতে আল্লাহর কাছে চাওয়ার রাত, উৎসব বা হইচই করার রাত নয়।
উপসংহার
লাইলাতুল কদর হলো আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। এই রাতে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। যদি আমরা ইখলাসের সাথে এক রাত ইবাদত করতে পারি, তবে তা আমাদের বিগত জীবনের সব গুনাহ মাফের উসিলা হতে পারে। তাই আসুন, রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বিজোড় রাতকে কদর মনে করে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকি।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
লাইলাতুল কদর কি নির্দিষ্ট কোনো রাতে?
না, এটি রমজানের শেষ ১০ দিনের যেকোনো বিজোড় রাতে হতে পারে। তবে ২৭শে রমজান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে অনেক আলেম মনে করেন।
মহিলারা কি এই রাতে বিশেষ আমল করতে পারবেন?
অবশ্যই। মহিলারা ঘরে বসে নামাজ, তিলাওয়াত ও জিকির করতে পারেন। পিরিয়ড চলাকালীন মহিলারা নামাজ পড়তে না পারলেও জিকির ও দোয়া চালিয়ে যেতে পারবেন।
কাজের কারণে জেগে না থাকতে পারলে কী হবে?
পুরো রাত সম্ভব না হলে অন্তত এশা ও ফজর নামাজ জামাতের সাথে পড়ার চেষ্টা করুন। হাদিস অনুযায়ী, এশা ও ফজর জামাতে পড়লে সারারাত ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়।
লাইলাতুল কদরের দোয়া কোনটি সবচেয়ে উত্তম?
নবীজি (সা.) শেখানো দোয়াটি শ্রেষ্ঠ: “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুওউন তুহিব্বুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নি”।
এই রাতে গুনাহ মাফ হয় কি?
হ্যাঁ, সহিহ হাদিস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদত করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
শুধু শেষ ১০ রাতেই কেন খোঁজা হয়?
রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সাহাবীগণ শেষ ১০ রাতে ইতেকাফ করতেন এবং কঠোর পরিশ্রম করতেন, তাই সুন্নাহ অনুযায়ী আমরা এই সময়েই কদর তালাশ করি।
Your comment will appear immediately after submission.