ইসলামে সুদ (রিবা) কেন হারাম? এর ক্ষতিকর প্রভাব ও বিকল্প ব্যবস্থা

প্রকাশিত হয়েছে: দ্বারা
✅ বিশেষজ্ঞ দ্বারা অনুমোদিত
5/5 - (1 vote)

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে, ইসলাম সুদ (আরবিতে ‘রিবা’) কে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং এটিকে হারাম ঘোষণা করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল একটি ধর্মীয় বিধান নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন, যা মানবজাতির কল্যাণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।

এই নিবন্ধে আমরা সুদ হারাম হওয়ার কারণ, এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং ইসলামী অর্থনীতির বিকল্প ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

Advertisements

সুদ (রিবা) কী ?

সুদ (রিবা) বলতে বোঝায় ঋণের উপর অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা। সহজ ভাষায়, যখন কেউ কাউকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থ ধার দেয় এবং শর্ত করে যে, সে মূল অর্থের অতিরিক্ত কিছু অর্থ ফেরত দেবে, তখন এই অতিরিক্ত অর্থই হলো সুদ। এটি আরবিতে ‘রিবা’ নামে পরিচিত, যার আভিধানিক অর্থ হলো ‘বৃদ্ধি’ বা ‘অতিরিক্ত’।

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে, রিবা দুই প্রকারের হতে পারে:

  • রিবা আল-ফাদল (অতিরিক্ত): একই জাতীয় পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে পরিমাণের তারতম্য।
  • রিবা আন-নাসিয়াহ (সময়): ঋণের উপর সময় বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ, যা প্রচলিত ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে দেখা যায়।

কেন ইসলামে সুদ হারাম করা হয়েছে ?

কুরআন ও সুন্নাহতে সুদকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

  • অবিচার ও শোষণ: সুদ ধনীকে আরও ধনী করে এবং গরিবকে আরও গরিব করে তোলে। এটি সমাজের দুর্বল শ্রেণীর উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং তাদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
  • ঝুঁকিবিহীন মুনাফা: ইসলামে ব্যবসা ও আয়ের জন্য ঝুঁকি গ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা কোনো ঝুঁকি ছাড়াই নিশ্চিত মুনাফা অর্জন করে, যা ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতির পরিপন্থী।
  • অর্থের অন্যায্য প্রবাহ: সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে অর্থ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, যা সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।
  • উৎপাদনশীলতার অভাব: সুদ উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিবর্তে কেবল অর্থ থেকে অর্থ উপার্জনকে উৎসাহিত করে, যা প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করে।
  • সামাজিক বিভেদ: সুদ সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, কারণ ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে একটি শোষক-শোষিতের সম্পর্ক তৈরি হয়।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” (সূরা বাকারা, ২:২৭৫)

এবং

“হে মুমিনগণ! তোমরা সুদ খেয়ো না, চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৩০)


সুদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাব কী?

সুদের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কুফল রয়েছে:

  • মুদ্রাস্ফীতি: সুদভিত্তিক ঋণ অর্থনীতিতে অতিরিক্ত অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটাতে পারে।
  • ঋণের ফাঁদ: দরিদ্র ও অভাবী মানুষ সুদের জালে জড়িয়ে পড়ে এবং ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে পারে না।
  • আর্থিক সংকট: সুদের উচ্চ হার আর্থিক সংকট এবং অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম কারণ হতে পারে, যেমনটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে।
  • বিনিয়োগে অনীহা: উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে মানুষ সুদভিত্তিক সঞ্চয় বা ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
  • নৈতিক অবক্ষয়: সুদ মানুষের মধ্যে লোভ, স্বার্থপরতা এবং অন্যের প্রতি উদাসীনতা তৈরি করে।

ইসলামী অর্থনীতিতে সুদের বিকল্প কী ?

ইসলামী অর্থনীতি সুদের পরিবর্তে ন্যায়ভিত্তিক এবং উৎপাদনশীল লেনদেনের উপর গুরুত্ব দেয়। এর প্রধান বিকল্পগুলো হলো:

  • মুদারাবা (লাভ-ক্ষতি অংশীদারিত্ব): একজন পুঁজি সরবরাহ করে এবং অন্যজন শ্রম ও দক্ষতা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। মুনাফা পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ হয়, এবং ক্ষতি হলে পুঁজিদাতা বহন করে।
  • মুশারাকা (যৌথ অংশীদারিত্ব): একাধিক পক্ষ পুঁজি এবং/অথবা শ্রম দিয়ে যৌথভাবে ব্যবসা করে এবং লাভ-ক্ষতি চুক্তি অনুযায়ী ভাগ করে নেয়।
  • মুরাবাহা (খরচ-মুনাফা বিক্রয়): ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো পণ্য ক্রয় করে গ্রাহকের কাছে একটি নির্দিষ্ট মুনাফা যোগ করে বিক্রি করে, যা কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়।
  • ইজারা (লিজ/ভাড়া): কোনো সম্পদ ভাড়া দেওয়া হয় এবং ভাড়ার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করা হয়।
  • কার্দ হাসানা (উত্তম ঋণ): এটি একটি সুদবিহীন ঋণ, যা অভাবী মানুষকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয় এবং শুধুমাত্র মূল অর্থ ফেরত নেওয়া হয়।
  • যাকাত ও সাদাকা: এগুলো সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং অর্থের প্রবাহকে সচল রাখে।

আধুনিক বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং কীভাবে কাজ করে ?

আধুনিক বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদমুক্ত লেনদেনের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। তারা প্রচলিত সুদের পরিবর্তে মুদারাবা, মুশারাকা, মুরাবাহা, ইজারা ইত্যাদি ইসলামী অর্থায়নের পদ্ধতি ব্যবহার করে। ইসলামী ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হালাল খাতকে প্রাধান্য দেয় এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা মেনে চলে। তাদের লক্ষ্য শুধু মুনাফা অর্জন নয়, বরং সমাজের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও কল্যাণ নিশ্চিত করা।


উপসংহার

ইসলামে সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে কারণ এটি একটি অন্যায্য ও শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এর পরিবর্তে ইসলাম এমন একটি অর্থনৈতিক মডেল উপস্থাপন করে যা ন্যায়বিচার, সমতা এবং সামাজিক সংহতির উপর প্রতিষ্ঠিত। সুদবিহীন ইসলামী অর্থনীতি কেবল মুসলিমদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি টেকসই ও কল্যাণকর বিকল্প প্রস্তাব করে।


প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

ইসলামে সুদ ও ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য কী?

ইসলামে ব্যবসা হালাল কারণ এতে ঝুঁকি এবং শ্রম উভয়ই জড়িত, এবং লাভ-ক্ষতি উভয়ই হতে পারে। পক্ষান্তরে, সুদ হারাম কারণ এতে ঋণদাতা কোনো ঝুঁকি না নিয়ে নিশ্চিত অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করে, যা শোষণের দিকে ধাবিত করে। ব্যবসা উৎপাদনশীল বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, যেখানে সুদ কেবল অর্থ থেকে অর্থ উপার্জনকে উৎসাহিত করে।

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার কি ইসলামে জায়েজ ?

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য। যদি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে শুধুমাত্র বিল পরিশোধ করা হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো অতিরিক্ত সুদ ছাড়া পুরো বিল পরিশোধ করা হয়, তাহলে তা জায়েজ হতে পারে। তবে, যদি বিল পরিশোধে বিলম্ব হয় এবং সুদ দিতে হয়, তাহলে সেই লেনদেনটি হারাম হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, সুদভিত্তিক ক্রেডিট কার্ড পরিহার করাই উত্তম।

হোম লোন বা গাড়ি কেনার জন্য কি সুদ নেওয়া যাবে

ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, হোম লোন বা গাড়ি কেনার জন্য সুদভিত্তিক ঋণ (যেমন প্রচলিত ব্যাংক লোন) নেওয়া জায়েজ নয়, কারণ এতে সুদের লেনদেন জড়িত। এর বিকল্প হিসেবে ইসলামী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুরাবাহা, ইজারা বা মুশারাকার মতো শরীয়াহসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করে গৃহঋণ বা গাড়ি অর্থায়নের ব্যবস্থা করে থাকে।

সুদমুক্ত বিনিয়োগের কিছু উদাহরণ দিন।

সুদমুক্ত বিনিয়োগের কিছু উদাহরণ হলো: ইসলামী বন্ড (সুকুক), হালাল স্টক মার্কেট বিনিয়োগ, ইসলামী মিউচুয়াল ফান্ড, হালাল রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগ (যেমন ভাড়াভিত্তিক আয়), মুদারাবা ও মুশারাকা ভিত্তিক অংশীদারিত্বের ব্যবসা, এবং হালাল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রিতে সরাসরি বিনিয়োগ।

অজান্তেই যদি কেউ সুদের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে, তার করণীয় কী?

যদি কেউ অজান্তেই বা বাধ্য হয়ে সুদের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে, তাহলে তার উচিত দ্রুত তওবা করা এবং সুদের লেনদেন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুদভিত্তিক চুক্তি বাতিল করা বা সুদ থেকে নিজেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ইতোমধ্যেই নেওয়া সুদের অর্থ যদি ফেরত দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে সেই অর্থ নিজে ভোগ না করে জনকল্যাণমূলক কাজে (যেমন দরিদ্রদের দান) ব্যয় করা উচিত, তবে সওয়াবের নিয়ত ছাড়া। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

Advertisements
Farhat Khan

Farhat Khan

ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক

আমার সব আর্টিকেল

Your comment will appear immediately after submission.

মন্তব্য করুন