আল্লাহ কে? কুরআনের আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা

প্রকাশিত হয়েছে: দ্বারা
✅ Expert-Approved Content
5/5 - (1 vote)

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটা সৃষ্টি এবং আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের পেছনে লুকিয়ে আছে এক চিরন্তন রহস্য: আল্লাহ কে? প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এই প্রশ্নটি কেবল একটি জিজ্ঞাসা নয়, এটি হলো জীবনের পরম সত্যের দিকে যাত্রা।

যখন আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করি, তখনই খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত—যা আমাদের বিশ্বাসের (ঈমানের) মূল ভিত্তি স্থাপন করে। পবিত্র আল-কুরআন এই মহাক্ষমতার অধিকারী, একচ্ছত্র স্রষ্টার সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত পরিচয় উন্মোচন করে, যা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য একত্ববাদ বা (তাওহিদ)-এর কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহ কে—এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান আমাদের ইসলামিক জীবনবোধ ও আকিদাকে শক্তিশালী করতে পারে, আর সেই অনুসন্ধানের সূচনাতেই শব্দটি উল্লেখ থাকা আবশ্যক।

Advertisements

সংক্ষেপে: আল্লাহ কে

কুরআনের আলোকে আল্লাহ কে? এক কথায়, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) হলেন এক ও অদ্বিতীয় (যার কোনো শরীক নেই), চিরঞ্জীব, সমস্ত সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তানিয়ন্ত্রণকারী। তিনি আদি, অন্তহীন এবং সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। তাঁর সত্তা কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নয়, কিন্তু সবকিছু তাঁরই মুখাপেক্ষী। তাঁর নিরানব্বইটি সুন্দর নাম বা আসমাউল হুসনা রয়েছে, যা তাঁর পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীর পরিচায়ক।


বিস্তারিত ব্যাখ্যা

আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় — একত্ববাদের মূল ভিত্তি

ইসলামের মূল মন্ত্রই হলো একত্ববাদ বা তাওহিদ, অর্থাৎ আল্লাহকে তাঁর সত্তা, গুণাবলী এবং ইবাদতে এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করা। আল্লাহ কে—এই প্রশ্নের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সংক্ষিপ্ত উত্তরটি দেওয়া হয়েছে সূরা ইখলাসে, যা আল্লাহর একত্বের ঘোষণা:

“বলো, তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেননি। আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।” (সূরা আল-ইখলাস ১১২:১–৪)

এই আয়াতগুলো পরিষ্কারভাবে আল্লাহর স্বতন্ত্রতা ও তাঁর সমতুল্য কারো না থাকার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে শিরকের (আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করা) সমস্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাঁর সৃজন, কর্তৃত্ব এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে অংশীদারবিহীন। একজন মুসলিমের জীবনের সমস্ত আমল এই তাওহিদের ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত। এটিই ইসলামের সবচেয়ে মৌলিক শিক্ষা।

আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, পরিচালনাকারী

আল্লাহ কে শুধু এক সত্তা, তাই নয়; তিনি মহাবিশ্বের একচ্ছত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক ও নিয়ন্ত্রক। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা, প্রতিটি সৃষ্টি তাঁরই ইচ্ছার অধীন। জীবন-মৃত্যু, জীবিকা, অসুস্থতা-আরোগ্য—সবকিছু তাঁর হাতে। কুরআন তাঁকে রব্বুল আলামীন (বিশ্বজগতের প্রতিপালক) হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর একটি অনন্য উদাহরণ হলো:

“আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তন্দ্রা বা ঘুম তাঁকে স্পর্শ করে না। আসমানসমূহে ও যমীনে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। কে সে, যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে? তাদের সামনে ও পিছনে যা কিছু আছে, তা তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসমুদ্র হতে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, তবে তিনি যতটুকু ইচ্ছা করেন। তাঁর আসন (কুরসী) আসমানসমূহ ও যমীনকে পরিবেষ্টন করে আছে। আর সেগুলোর সংরক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না। তিনিই সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ।” (সূরা আল-বাকারাহ :২৫৫ – আয়াতুল কুরসী)

তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, আর সেগুলোর নিরবচ্ছিন্ন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণও তিনিই করছেন। তিনিই রিজিকদাতা এবং তিনিই একমাত্র সত্তা, যিনি সমস্ত কিছুর পূর্ণাঙ্গ পরিচালক। এই বিশ্বাস বান্দাকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ ও নির্ভরশীল করে তোলে।

আল্লাহর গুণাবলী (আসমাউল হুসনা)

আল্লাহর পরিচয় তাঁর আসমাউল হুসনা (সুন্দরতম নামসমূহ)-এর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই নামগুলি আল্লাহর গুণাবলী এবং তাঁর মহিমাকে তুলে ধরে। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম আছে, যারা এগুলো গণনা করবে (অর্থাৎ মুখস্থ করবে এবং এর তাৎপর্য বুঝে আমল করবে) তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।

“আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম রয়েছে—এক কম একশো। যে ব্যক্তি এগুলো গণনা করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৭৭)

এই নামগুলির মধ্যে রয়েছে আল-রাহমান (পরম দয়ালু), আল-রাহীম (অতিশয় মেহেরবান), আল-মালিক (মহাসম্রাট), আল-আলীম (মহাজ্ঞানী), আল-হায়্য (চিরঞ্জীব) এবং আল-কাইয়্যুম (চিরস্থায়ী)। আল্লাহর পরিচয় জানার অর্থই হলো এই নামগুলির জ্ঞান অর্জন করে সেগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করা।

আল্লাহকে মানুষের দৃষ্টিতে দেখা যায় না, কিন্তু সব জানেন ও দেখেন

আল্লাহ কে—তা জানার ক্ষেত্রে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, তিনি আমাদের এই পার্থিব চোখে অদৃশ্য। মানুষ আল্লাহর সত্তাকে কোনো সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে না। তিনি এমন এক সত্তা, যা আমাদের অনুভূতির বাইরে, কিন্তু তিনি আমাদের সবকিছু দেখেন এবং জানেন। কুরআন ঘোষণা করে:

“কোনো চক্ষু তাঁকে দেখতে পায় না; আর তিনি সব চক্ষুকে দেখেন। আর তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত।” (সূরা আল-আন’আম :১০৩)

যদিও আমরা তাঁকে দেখতে পাই না, তিনি প্রতিটি মানুষের মনের গোপন বিষয় এবং আকাশের তারকারাজির অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত। এই বিশ্বাসই ইহসান (আল্লাহকে দেখার মতো করে ইবাদত করা, যদিও আমরা না দেখি, তিনি তো আমাদের দেখেন) নামক উচ্চতর আধ্যাত্মিক স্তরের ভিত্তি তৈরি করে।


বাস্তব উদাহরণ / বিশ্বাসের প্রয়োগ

একজন মুসলিমের জীবনে আল্লাহ কে—তা জানার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই জ্ঞান তাকে আল্লাহ-ভীতি (তাকওয়া) এবং একনিষ্ঠতা (ইখলাস)-এর দিকে চালিত করে।

  • নামাজে মনোযোগ: যখন বান্দা জানে যে সে এমন এক সত্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যিনি চিরঞ্জীব, সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা, তখন তার নামাজে একাগ্রতা আসে।
  • জীবিকার চিন্তা: আল্লাহই একমাত্র রিজিকদাতা—এই বিশ্বাস একজন মুসলিমকে অবৈধ উপার্জন থেকে দূরে রাখে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) করতে শেখায়।
  • দৈনন্দিন আমল: চুরি, মিথ্যা বা অন্য কোনো অন্যায় কাজ করার আগে সে বিরত থাকে, কারণ সে জানে যে মানুষ না দেখলেও আল-বাসীর (সর্বদ্রষ্টা) আল্লাহ তাকে দেখছেন। এই জ্ঞান তাকে জীবনের প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে উৎসাহিত করে। এই সন্তুষ্টি অর্জন করাই একজন বিশ্বাসীর জীবনের লক্ষ্য।

ভুল ধারণা ও সতর্কতা

আল্লাহ কে—তা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা থেকে দূরে থাকা আবশ্যক:

  • আল্লাহকে মানুষের মতো কল্পনা করা: আল্লাহ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তিনি তুলনীয় নন। আল্লাহকে কোনো মানবীয় আকার বা গুণাবলী দ্বারা চিত্রিত করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কুরআন স্পষ্ট করে: “তাঁর (আল্লাহর) মতো কোনো কিছুই নেই।” (সূরা আশ-শূরা ৪২:১১)
  • আল্লাহর সাথে তুলনা করা: আল্লাহর নাম বা গুণাবলীকে কোনো সৃষ্টির নাম বা গুণের সাথে তুলনা করা বা সাদৃশ্য স্থাপন করা। তাঁর গুণাবলী তাঁর জন্য স্বতন্ত্র, আর সৃষ্টির গুণাবলী সৃষ্টির জন্য।
  • কুরআন-বহির্ভূত ধারণা বিশ্বাস করা: আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী বা তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদিসের বাইরে কোনো কাল্পনিক বা ভিত্তিহীন ধারণা বিশ্বাস করা উচিত নয়। ধর্মীয় জ্ঞান সবসময় আল্লাহর প্রত্যাদেশ দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।

উপসংহার

আল্লাহ কে—এই প্রশ্নটিই হলো ইসলামের স্তম্ভ। তিনি এক (তাওহিদ), অদ্বিতীয় এবং সমস্ত সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক। তাঁর আসমাউল হুসনা তাঁর পূর্ণাঙ্গ মহিমা ও ক্ষমতাকে তুলে ধরে। এই জ্ঞান একজন মুসলিমকে আল্লাহ-ভীতি, একনিষ্ঠ ইবাদত এবং তাঁর ওপর পূর্ণ ভরসার জীবনে পরিচালিত করে। আল্লাহর একত্বে দৃঢ় বিশ্বাসই আমাদের ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের চাবিকাঠি। তাই, কুরআনের আলোকে আল্লাহর পরিচয় জানা ও বোঝা আমাদের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু

প্রশ্ন ও উত্তর

আল্লাহকে কেন দেখা যায় না?

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আমাদের এই পার্থিব দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। তাঁর সত্তা এতটাই মহৎ যে, কোনো মানব চক্ষু তাঁকে দেখতে সক্ষম নয়। তবে, বিশ্বাসীরা বেহেশতে আল্লাহকে দেখতে পাবে, যা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার হবে।

আল্লাহ কি সর্বত্র আছেন?

আল্লাহ তাঁর সত্তায় আরশের (সিংহাসন) উপরে আছেন, যেমনটি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। তবে তাঁর জ্ঞান, ক্ষমতা, দৃষ্টি এবং কর্তৃত্ব সর্বত্র বিরাজমান। তিনি তাঁর সৃষ্টির খুব কাছেই আছেন এবং আমাদের মনের সমস্ত কথা জানেন।

আল্লাহর কতটি নাম?

সহীহ হাদিস অনুসারে আল্লাহর নিরানব্বইটি সুন্দর নাম বা আসমাউল হুসনা রয়েছে। এই নামগুলি তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত গুণাবলীকে নির্দেশ করে।

আল্লাহ কি বিশ্বের সবকিছু জানেন?

হ্যাঁ, আল্লাহ হলেন মহাজ্ঞানী। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, যা প্রকাশ্য বা গোপন—বিশ্বের সবকিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। আসমানসমূহ ও যমীনে কোনো কিছুই তাঁর অজানা নেই।

আল্লাহকে ভালোবাসার ইসলামী উপায় কী?

আল্লাহকে ভালোবাসার প্রধান ইসলামী উপায় হলো তাঁর আদেশসমূহ পালন করা (যেমন নামাজ, রোজা), তাঁর নিষেধসমূহ থেকে বিরত থাকা এবং তাঁর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আদর্শ অনুসরণ করা।

অন্যান্য ধর্মের ঈশ্বর ও আল্লাহ কি একই?

ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে, আল্লাহ কে—তা হলো সেই এক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টা, যিনি সমস্ত জগতের প্রতিপালক। যদি অন্য ধর্মের অনুসারীরা সেই একই এক ও অদ্বিতীয়, নিরাকার, সৃষ্টিকর্তা সত্তার উপাসনা করেন, তবে তারা আল্লাহরই ইবাদত করছে। তবে, ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহকে শুধুমাত্র তাঁর গুণাবলী ও নির্দেশিত পথেই ইবাদত করতে হয়, যেখানে কোনো শিরক বা অংশীদারিত্বের সুযোগ নেই।

রেফারেন্স

  • উলামার মত: ইসলামিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে একত্ববাদের ব্যাখ্যায় সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করা হয়েছে।
  • আল-কুরআন: সূরা আল-ইখলাস (১১২:১-৪), সূরা আল-বাকারাহ (২:২৫৫), সূরা আল-আন’আম (৬:১০৩), সূরা আশ-শূরা (৪২:১১)।
  • সহীহ হাদিস: সহীহ মুসলিম, কিতাবুল যিকর ওয়াদ-দু’আ, হাদিস নং: ২৬৭৭ (আসমাউল হুসনা সংক্রান্ত)।
Advertisements
Avatar of Farhat Khan

Farhat Khan

আমি ফারহাত খান— একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক। কুরআন-হাদীসের বিশুদ্ধ জ্ঞানকে আধুনিক চিন্তার আলোকে সহজ ও হৃদয়ছোঁয়াভাবে তুলে ধরি। সত্যনিষ্ঠ ইসলামic ব্যাখ্যা, গভীর গবেষণা এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে পাঠকের মনে আলো জ্বালানোই আমার লক্ষ্য।

আমার সব আর্টিকেল

Your comment will appear immediately after submission.

মন্তব্য করুন