জীবন এক দীর্ঘ পথ—যার শুরু হয় জন্ম থেকে, আর শেষ গন্তব্য মৃত্যু। এই পথচলা শুধু জীবনের দর্শন নয়, দৈনন্দিন বাস্তবতাও। সকাল থেকে রাত, মানুষ তার প্রয়োজন, স্বপ্ন, দায়িত্ব আর সংগ্রামের খাতিরে রাস্তায় নামে। কিন্তু সেই রাস্তাই যদি হয় বিড়ম্বনার কারণ, তবে জীবন যেন হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর এক যাত্রা।
১. শহুরে ট্র্যাফিকের ধাঁধাঁ
একটি শহরের গতি মাপা যায় তার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উপর। কিন্তু আমাদের শহরগুলোতে প্রতিদিন সকাল হলেই শুরু হয় যানজটের আতঙ্ক। রাস্তা যেন চলে যায় গাড়ির দখলে, আর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে প্রতীক্ষায়—একটি সিগন্যাল পার হওয়ার জন্য অর্ধঘণ্টা সময় চলে যায় যেন চোখের পলকে।
বাস স্টপে বাস থামে না ঠিক জায়গায়, আবার থামলেই ছুটে আসে শত লোকের ভিড়। প্রাইভেটকার, উবার, মোটরসাইকেল, রিকশা—সব মিলে তৈরি হয় বিশৃঙ্খল এক সড়কচিত্র। চালকদের মধ্যে নেই ধৈর্য, যাত্রীর মধ্যে নেই সচেতনতা, আর ট্রাফিক ব্যবস্থার মাঝে নেই কার্যকরী সমাধান।
২. ফুটপাত কার?
পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ফুটপাত, যা পথচারীদের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু আমাদের দেশে ফুটপাত যেন হয়ে উঠেছে দোকানিদের আয়ের জায়গা, রাজনৈতিক পোস্টারের দেওয়াল, কিংবা গৃহহীনদের ঘরবাড়ি। পথচারীরা বাধ্য হয় রাস্তায় নামতে, আর সেই রাস্তাতেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
কখনো কখনো দেখা যায়, শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই জীবন ঝুঁকি নিয়ে চলছেন গাড়ির পাশে পাশে, কারণ ফুটপাত নামেই আছে, কাজে নেই।
৩. নারীর চলার পথে নতুন বিপত্তি
নারীর পথচলা এখনও অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে কর্মজীবী নারী বা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত পড়তে হয় মানসিক চাপ ও অনিরাপত্তার মুখে। ইভ টিজিং, বাজে মন্তব্য, এমনকি শারীরিক হেনস্তার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
যদিও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা এসেছে—যেমন সিসিটিভি, নারী পুলিশের টহল, মোবাইল অ্যাপ—but মূল পরিবর্তন আসতে হবে মানসিকতায়। নারীর নিরাপদ চলাচল শুধু আইন বা বাহিনীর মাধ্যমে সম্ভব নয়, প্রয়োজন সমাজের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি।
৪. বর্ষার পথে বিপর্যয়
একটি বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় শহরের আসল চিত্র। রাস্তা হয়ে ওঠে নদী, ড্রেনের ঢাকনা উঠে পড়ে থাকে, আর খানাখন্দে পানি জমে যায়। মানুষ তখন আর হেঁটে চলে না—পাড়ি দেয়।
জলাবদ্ধতার কারণে যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়, অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়, স্কুলগামী শিশুরা ভিজে যায়, আর রোগ-জীবাণুর ভয়ও বেড়ে যায়। এই ভোগান্তির পেছনে দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, আর নাগরিক অসচেতনতা।
৫. পথের মানুষগুলো
পথ শুধু চলাচলের মাধ্যম নয়, পথের সাথে জড়িত বহু মানুষের জীবন। রিকশাচালক, হকার, ট্রাফিক পুলিশ, পথশিশু—সবাই এই পথের সাথে যুক্ত। তারা নিজের জীবনকে উত্সর্গ করছে চলমান শহরের চাকা সচল রাখতে। কিন্তু এই মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ, নেই সুরক্ষা, নেই সম্মান। অথচ তারা না থাকলে শহর থেমে যেত।
৬. সমাধানের উপায়
পথের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন—
- সচেতন নাগরিকতা: সবাই যদি নিয়ম মানে, রাস্তায় ট্র্যাফিক আইন মেনে চলে, ফুটপাত দখল না করে, পথচারীদের সম্মান করে—তাহলেই বিশৃঙ্খলা অনেক কমবে।
- প্রযুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা: স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম, GPS-ভিত্তিক বাস ট্র্যাকিং, ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত লেন ব্যবস্থাপনা করলে যানজট অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আসবে।
- নারীর নিরাপত্তা জোরদার করা: নারীদের জন্য আলাদা বাস লেন, নারী হেল্পলাইন, ও সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
- বর্ষা উপযোগী অবকাঠামো: উন্নত ড্রেনেজ, রাস্তার উচ্চতা পরিকল্পনা করে নির্মাণ, এবং জলাবদ্ধতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- পথসংশ্লিষ্ট মানুষের উন্নয়ন: পথের শ্রমজীবী মানুষদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, বিশ্রামকেন্দ্র, ও সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার
পথের বিড়ম্বনা কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়—এটি আমাদের সম্মিলিত অবহেলার ফল। তবে মানুষ চাইলেই পরিবর্তন আনতে পারে। আজ যদি আমরা সবাই একসাথে সচেতন হই, নিয়ম মানি, আর নিজেদের মতো করে না ভেবে সমাজের কথা ভাবি—তাহলে পথ শুধু চলার মাধ্যম নয়, হয়ে উঠবে জীবনের নির্ভরতার সঙ্গী।
লেখক: তৈয়বুর রহমান
creativetaibur@gmail.com
Your comment will appear immediately after submission.