ইসরায়েলের ছকে চলবে না আর মধ্যপ্রাচ্য

প্রকাশিত হয়েছে: 26 জুন, 2025 দ্বারা Taibur Rahman
✅ বিশেষজ্ঞ দ্বারা অনুমোদিত
5/5 - (1 vote)

১৯৪০ সালের ১৪ নভেম্বর, জার্মানির লুফটওয়াফে বাহিনী ব্রিটেনের কভেন্ট্রি শহরে এক তীব্র বিমান হামলা চালিয়েছিল। জার্মান প্রচারণা বলেছিল, এটিই ছিল পুরো যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ। সেই হামলার উল্লাসে নাৎসি প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস ‘টু কভেনট্রেট’ নামে একটি শব্দও চালু করেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন পথে হাঁটছিল। ব্রিটিশরা দ্রুত তাদের অ্যারো ইঞ্জিন ও বিমান কারখানাগুলো গোপন অবস্থানে সরিয়ে নেয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উৎপাদন ক্ষমতা ধরে রাখে। কয়েক মাসের মধ্যে সেই কারখানাগুলো আবার চালু হয়।

এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি বর্তমান পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, ইসরায়েল ইরানে আকস্মিক হামলা চালিয়ে যা অর্জন করতে চেয়েছিল, তা হয়নি। বরং ১২ দিনের মধ্যেই সেই সামরিক অভিযানের ফলাফল কৌশলগত পরাজয়ের আকার নিয়েছে।

ইসরায়েলের তিনটি মূল লক্ষ্য ব্যর্থ

১. ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস:
ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি ছিল, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে তার কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্র বলছে, ইরান আগেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক সরঞ্জাম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলতে পেরেছিল। এখনও তাদের কাছে উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত রয়েছে বলেই ধারণা।

  1. পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ধ্বংস:
    পেন্টাগনের গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন হামলায় ইরানের মূল পারমাণবিক কাঠামো ধ্বংস হয়নি। সাময়িকভাবে কার্যক্রম পেছানো গেলেও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
  2. শীর্ষ বিজ্ঞানী ও জেনারেলদের নির্মূল:
    হামলার শুরুতে ইরানি বিজ্ঞানী ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হলেও তাদের স্থানে নতুন ব্যক্তিরা দ্রুত দায়িত্ব নিয়েছেন। এতে করে ইরানের সামরিক কাঠামো ভেঙে পড়েনি।

ইরান ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এবং দৃঢ়ভাবে

ইসরায়েলের আক্রমণের জবাবে ইরান যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, তা ছিল লক্ষ্যভিত্তিক ও অত্যন্ত কার্যকর। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও তেল শোধনাগার আক্রান্ত হয়েছে, এমনকি সামরিক স্থাপনাও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে বলে ইরান দাবি করেছে। যদিও ইসরায়েলের সেন্সর নীতির কারণে তা যাচাই কঠিন।

এই ১২ দিনের লড়াইয়ে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি হিজবুল্লাহ বা হামাসের সঙ্গে বছরের পর বছর যুদ্ধের চেয়েও বেশি। ইসরায়েলি নাগরিকদের ঘরবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বিধ্বস্ত হয়েছে—যা আগে তারা শুধু গাজা বা লেবাননের যুদ্ধের সময় অন্যদের ঘরে দেখেছে, এবার তা নিজেদের ঘরেই দেখেছে।

জাতীয় ঐক্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ইরানের শক্তি

ইরানের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের জাতিগত ঐক্য ও প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরতা। হামলার মধ্যেও তারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে। এমনকি ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসন উল্টো ইরানিদের আরও সংহত করেছে।

ইসরায়েল চেয়েছিল ইরানকে গাজার মতো এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মাঝপথেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। গাজার ওপর ইচ্ছেমতো আগ্রাসন চালালেও, ইরানের বেলায় তেমনটা করতে পারেনি ইসরায়েল। কারণ নেতানিয়াহুর পক্ষে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না।

আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় ইসরায়েলের নতুন চ্যালেঞ্জ

একসময় মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইসরায়েল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, তারা আর এককভাবে ভূরাজনৈতিক ছক তৈরি করতে পারছে না। ইরানের প্রতিরোধ, জনগণের দৃঢ়তা এবং বৈশ্বিক কূটনীতির জটিল বাস্তবতা ইসরায়েলকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।

এই যুদ্ধ দেখিয়েছে, কেবল বাহ্যিক ধ্বংসই নয়, মনোবল, জাতীয় ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক সমীকরণ—সব মিলিয়েই প্রকৃত বিজয় নির্ধারিত হয়।


লেখক: সম্পাদকীয় টিম, নাজিবুল.কম
তথ্যসূত্র: মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া রিপোর্ট

Avatar of Taibur Rahman

Taibur Rahman

আমি তৈয়বুর রহমান। লেখা আমার অভ্যাস নয়, এটা আমার প্রকাশের মাধ্যম। নাজিবুল ডটকমে আমি এমন কন্টেন্ট তৈরি করি যা শুধু তথ্য দেয় না, চিন্তার খোরাকও যোগায়। লক্ষ্য একটাই – জটিল বিষয়কে সহজ করে পাঠকের মনে গেঁথে যাওয়া।

আমার সব আর্টিকেল

মন্তব্য করুন