বোলপুর, ১ জুন, ২০২৫: বীরভূমের ‘কেষ্টদা’ নামে পরিচিত তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অনুব্রত মণ্ডলকে ঘিরে নতুন করে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। সম্প্রতি একটি ভাইরাল অডিও ক্লিপে (viral audio clip) বোলপুর থানার ইনস্পেক্টর-ইন-চার্জ (IC) লিটন হালদারকে হুমকি ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ ওঠার পর থেকেই উত্তাল রাজ্য-রাজনীতি। শনিবারের পর আজ, রবিবারও (১ জুন, ২০২৫) SDPO অফিসে হাজিরা এড়িয়ে গেলেন অনুব্রত মণ্ডল। তবে এই বিতর্কের মধ্যে কেষ্ট ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতারা এবার এক বিস্ফোরক দাবি করেছেন – ভাইরাল অডিওটি নাকি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, যার নেপথ্যে রয়েছে বিরোধী দল বিজেপি।
- ডেডলাইন পার, হাজিরা এড়িয়ে আবারও অসুস্থতার দাবি: এক চেনা চিত্র
- AI-এর তত্ত্ব: রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের নতুন হাতিয়ার?
- তৃণমূলের কড়া অবস্থান ও অনুব্রতর দ্রুত ক্ষমা প্রার্থনা
- পুলিশি পদক্ষেপ এবং তদন্তের গতিপ্রকৃতি: আইনি জটিলতা
- পুরোনো বিতর্ক ও কেষ্টর বর্তমান পরিস্থিতি: এক দীর্ঘ আইনি সংগ্রাম
- প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
ডেডলাইন পার, হাজিরা এড়িয়ে আবারও অসুস্থতার দাবি: এক চেনা চিত্র
পুলিশের কাছে হাজিরা দেওয়ার ডেডলাইন পার হয়ে গেলেও, নির্ধারিত সময় অর্থাৎ রবিবার সকাল ১১টায় বোলপুর SDPO অফিসে পৌঁছাননি অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর আইনজীবীরা SDPO অফিসে উপস্থিত হয়ে অনুব্রতর অসুস্থতার কথা জানিয়ে আরও সময় চেয়েছেন। জানা গেছে, তীব্র শারীরিক অসুস্থতা এবং “বেড রেস্টের” পরামর্শের কারণেই তিনি হাজিরা দিতে পারেননি। এটি অবশ্য অনুব্রত মণ্ডলের ক্ষেত্রে নতুন নয়; এর আগেও তিনি গরু পাচার মামলা বা ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায় একাধিকবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির (CBI, ED) তলব এড়িয়ে গেছেন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে। তাঁর আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তিনি কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
AI-এর তত্ত্ব: রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের নতুন হাতিয়ার?
এই মুহূর্তে গোটা বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপটি। এই অডিও ক্লিপে একটি কণ্ঠস্বরকে অনুব্রত মণ্ডলের বলে দাবি করা হচ্ছে, যেখানে তিনি এক পুলিশ অফিসারকে আপত্তিকর ভাষায় গালিগালাজ করছেন এবং এমনকি তাঁর স্ত্রী ও মায়ের সম্পর্কেও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছেন বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় রাজ্য রাজনীতিতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে পুলিশের প্রতি এমন আচরণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
কিন্তু এই বিতর্ককে সম্পূর্ণ নতুন দিকে মোড় দিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা গগন সরকার। তিনি সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন যে, এই অডিও ক্লিপটি AI (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে এবং এর পেছনে বিজেপি-র চক্রান্ত রয়েছে। তাঁর দাবি, “মণ্ডল কাউকে ফোন করেননি, এবং যে কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে তা AI ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।” গগন সরকার আরও বলেন, সম্প্রতি AI প্রযুক্তির মাধ্যমে ভয়েস ক্লোনিং (voice cloning) এবং ডিপফেক অডিও (deepfake audio) তৈরি করা খুবই সহজ হয়ে গেছে, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অপব্যবহার করা হচ্ছে। এই দাবি যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে এই ঘটনা সাইবার ক্রাইম এবং রাজনৈতিক চক্রান্তের এক নতুন, বিপজ্জনক দিক উন্মোচন করবে। ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই অডিওর সত্যতা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভাইরাল অডিও এবং অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
বিষয় | অভিযোগ/দাবি | বর্তমান অবস্থান/পাল্টা দাবি |
---|---|---|
অডিও ক্লিপ | বোলপুর IC লিটন হালদারকে হুমকি ও অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে পুলিশকে অসম্মান করা | অনুব্রত ঘনিষ্ঠদের দাবি: AI দ্বারা তৈরি ভয়েস ক্লোনিং, বিজেপি-র রাজনৈতিক চক্রান্ত। ফরেনসিক পরীক্ষার দাবি। |
পুলিশের তলব | SDPO অফিসে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ (২য় বার) | অনুব্রতর অনুপস্থিতি, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আইনজীবীদের মাধ্যমে সময় চেয়ে আবেদন। বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। |
FIR দায়ের | ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর একাধিক ধারায় মামলা রুজু, জামিন অযোগ্য ধারার প্রয়োগ | তদন্ত প্রক্রিয়াধীন, অডিও-র সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা, প্রযুক্তির অপব্যবহারের অভিযোগের গুরুত্ব বাড়ছে। |
তৃণমূলের কড়া অবস্থান ও অনুব্রতর দ্রুত ক্ষমা প্রার্থনা
ভাইরাল অডিও ক্লিপ নিয়ে বিতর্ক চরমে পৌঁছানোর পর তৃণমূল কংগ্রেস দ্রুত কড়া অবস্থান নেয়। দলের পক্ষ থেকে শুক্রবার (৩০ মে, ২০২৫) একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করে অনুব্রত মণ্ডলের ব্যবহৃত ভাষার তীব্র নিন্দা করা হয় এবং তাকে চার ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তৃণমূলের একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই ধরনের অশালীন মন্তব্য দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
দলের কড়া অবস্থানের মুখে অনুব্রত মণ্ডল মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যেই ক্ষমা চেয়ে একটি লিখিত চিঠি দেন বোলপুর IC লিটন হালদারকে এবং আরেকটি চিঠি দেন তৃণমূল রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে। এই চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমার ওই কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। আমি দুঃখিত।” তিনি সংবাদমাধ্যমকেও জানান, “আমি নানা রকম ওষুধ খাই। শুনলাম, আমাদের এক তৃণমূল কর্মীর ছেলেকে পুলিশ মারধর করেছে। নিরীহ ছেলে। এতেই আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। সত্যি আমি দুঃখিত।” যদিও তিনি একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন, কিভাবে তাঁর কথোপকথনের অডিও ফাঁস হল এবং এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা। এই প্রশ্নই এখন AI তত্ত্বের দাবির সাথে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
পুলিশি পদক্ষেপ এবং তদন্তের গতিপ্রকৃতি: আইনি জটিলতা
ভাইরাল অডিও ক্লিপ এবং লিটন হালদারের অভিযোগের ভিত্তিতে বোলপুর থানার পুলিশ অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর একাধিক ধারায় FIR (First Information Report) দায়ের করেছে। এর মধ্যে BNS-এর ২২৪ (সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও কর্তব্যরত অফিসারকে হুমকি), ১৩২ (সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে হামলা বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ), ৭৫ (শ্লীলতাহানি ও হয়রানি) এবং IPC-র ৩৫১ (অপরাধমূলক ভয় দেখানো) ধারাগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পুলিশ সুপার অমনদীপ জানিয়েছেন, এই মামলাগুলির মধ্যে কিছু ধারা জামিন অযোগ্য। এর অর্থ হলো, অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হলে তিনি সহজে জামিন নাও পেতে পারেন।
এই ঘটনার পর শনিবার সকালে অনুব্রতকে প্রথমবার SDPO অফিসে তলব করা হলেও, তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়িয়ে যান। এরপর পুলিশ দ্বিতীয়বার তাকে রবিবার সকাল ১১টায় হাজিরা দিতে নির্দেশ দেয়, যা তিনি আবারও এড়িয়ে গেছেন। অনুব্রতর আইনজীবী মারফত পুলিশকে জানানো হয়েছে, তিনি সুস্থ হলেই হাজিরা দেবেন। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে আলোচনা করছে। সূত্রের খবর, পুলিশ প্রয়োজনে তাঁর চিকিৎসার কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে পারে এবং প্রয়োজন মনে করলে আইনি পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
পুরোনো বিতর্ক ও কেষ্টর বর্তমান পরিস্থিতি: এক দীর্ঘ আইনি সংগ্রাম
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিতর্কের ইতিহাস নতুন নয়। গরু পাচার মামলা (Cattle Smuggling Case) এবং ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায় (Post-Poll Violence Case) CBI এবং ED-র হাতে গ্রেফতার হয়ে তিনি প্রায় দুই বছর জেল খেটেছেন। গত বছর (২০২৪ সালে) সুপ্রিম কোর্ট তাকে গরু পাচার মামলায় জামিন দিলেও, ED-র মামলায় তিনি হেফাজতে ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন শর্তাধীনে জামিনে মুক্ত থাকলেও, তাঁর উপর নজরদারি জারি রয়েছে। সম্প্রতি তাকে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতির পদ থেকেও অপসারণ করা হয়েছে, যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের এই বিশ্বস্ত সৈনিকের রাজনৈতিক জীবনে এক বড় পরিবর্তন এনেছে।
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহের সর্বশেষ অবস্থা:
মামলার প্রকার | বর্তমান অবস্থা |
---|---|
গরু পাচার মামলা | সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন প্রাপ্ত (২০২৪ সাল), তবে ED-র তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াধীন। |
ভোট পরবর্তী হিংসা | CBI দ্বারা তদন্তাধীন, একাধিক অভিযোগ রয়েছে, বিচার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। |
ভাইরাল অডিও বিতর্ক | FIR দায়ের, পুলিশি তলব, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়ানো, AI তত্ত্বের দাবি, তৃণমূলের ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ। তদন্ত চলমান। |
একদিকে তার স্বাস্থ্যগত জটিলতা, অন্যদিকে একাধিক আইনি জটিলতা এবং এবার AI-এর মাধ্যমে অডিও তৈরির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ – সব মিলিয়ে অনুব্রত মণ্ডল এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। এই ঘটনার তদন্ত কোন দিকে মোড় নেয়, বিশেষ করে AI তত্ত্বের বিষয়টি ফরেনসিক রিপোর্টে কতটা প্রমাণিত হয়, তা জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষ। এই ঘটনা কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি নতুন কৌশল, নাকি প্রযুক্তির অপব্যবহারের একটি মারাত্মক উদাহরণ, তা সময়ই বলে দেবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে নতুন করে কী অভিযোগ উঠেছে?
একটি ভাইরাল অডিও ক্লিপে বোলপুর থানার IC-কে হুমকি ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, যা নিয়ে FIR দায়ের হয়েছে।
অনুব্রত মণ্ডল কি পুলিশের তলবে হাজিরা দিয়েছেন?
না, শনিবারের পর রবিবার (১ জুন, ২০২৫) সকালে বোলপুর SDPO অফিসে তাকে দ্বিতীয়বার তলব করা হলেও, তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়িয়ে গেছেন। তাঁর আইনজীবীরা সময় চেয়ে আবেদন করেছেন।
অনুব্রত ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা ভাইরাল অডিও সম্পর্কে কী দাবি করেছেন?
তিনি দাবি করেছেন যে ভাইরাল অডিও ক্লিপটি Artificial Intelligence (AI) প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে এবং এর পেছনে বিজেপি-র রাজনৈতিক চক্রান্ত রয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনায় কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
তৃণমূল কংগ্রেস অডিও ক্লিপের ভাষার তীব্র নিন্দা করেছে এবং অনুব্রত মণ্ডলকে চার ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অনুব্রত মণ্ডল দলের নির্দেশে ক্ষমা চেয়ে চিঠিও দিয়েছেন।
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে কী কী ধারায় মামলা রুজু হয়েছে?
ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর ২২৪, ১৩২, ৭৫ এবং IPC-র ৩৫১ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। এই ধারাগুলির মধ্যে কিছু জামিন অযোগ্য।
অনুব্রত মণ্ডলের বর্তমান শারীরিক অবস্থা কেমন?
তাঁর আইনজীবীদের মতে, অনুব্রত মণ্ডল তীব্র শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন এবং বর্তমানে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
AI দ্বারা অডিও তৈরির দাবিটি কি প্রমাণিত?
না, এই দাবিটি এখনো প্রমাণিত হয়নি। অডিওটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন।