বোলপুর, ৪ জুন, ২০২৫: বীরভূমের প্রভাবশালী তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অনুব্রত মণ্ডলকে ঘিরে বিতর্ক যেন থামছেই না। বোলপুর থানার ইনস্পেক্টর-ইন-চার্জ (IC) লিটন হালদারকে হুমকি ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার আজ ৭ দিন পূর্ণ হলো, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তিনি পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজিরা দিলেন না। গত ২৮ মে, ২০২৫ (শনিবার) থেকে দফায় দফায় তাঁকে তলব করা হলেও, প্রতিবারই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়িয়ে যাচ্ছেন ‘কেষ্টদা’। এই ধারাবাহিক অনুপস্থিতি রাজ্য-রাজনীতিতে নতুন করে জল্পনার সৃষ্টি করেছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর চাপ বাড়িয়েছে।
হাজিরায় অনীহা: সাত দিনের সময়সীমা ও আইন-আদালতের খেলা
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল গত ২৮ মে, ২০২৫ তারিখে। একটি ভাইরাল অডিও ক্লিপে (যার সত্যতা ফরেনসিক পরীক্ষার অপেক্ষায়) অনুব্রত মণ্ডলের কণ্ঠস্বর বলে দাবি করে আইসি লিটন হালদারকে অশালীন ভাষায় হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে বোলপুর থানায় অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর ২২৪, ১৩২, ৭৫ ধারা এবং IPC-র ৩৫১ ধারায় FIR দায়ের হয়। এই ধারাগুলির মধ্যে কিছু জামিন অযোগ্য, যা মামলার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। FIR দায়েরের পরপরই পুলিশ অনুব্রতকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে।
- ২৮ মে, ২০২৫ (শনিবার): বিতর্কিত অডিও প্রকাশ্যে আসার পর অনুব্রতকে প্রথমবার বোলপুর SDPO অফিসে তলব করা হয়। তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়ান।
- ২৯ মে, ২০২৫ (রবিবার): পুলিশি সূত্রের খবর, সেদিনও তাকে পরোক্ষভাবে হাজিরা দিতে বলা হয়েছিল, যদিও কোনো আনুষ্ঠানিক সমন জারি হয়নি। অনুব্রত সাড়া দেননি।
- ১ জুন, ২০২৫ (রবিবার): দ্বিতীয়বার আনুষ্ঠানিক তলব করা হয়। আবারও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি অনুপস্থিত থাকেন। তাঁর আইনজীবীরা SDPO অফিসে উপস্থিত হয়ে অনুব্রতর শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে আরও সময় চেয়ে আবেদন করেন।
- ২ জুন, ২০২৫ (সোমবার): তৃতীয়বারের মতো পুলিশি তলব আসে। এইদিনও তিনি হাজিরা দেননি, তাঁর আইনজীবীরা জানান, তিনি কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং ‘বেড রেস্ট’-এর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
- ৪ জুন, ২০২৫ (বুধবার): আজ মামলার ৭ দিন পূর্ণ হলো। পুলিশি সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত অনুব্রত মণ্ডলের কাছ থেকে কোনো নতুন সাড়া মেলেনি। তার হাজিরা নিয়ে অনিশ্চয়তা বজায় রয়েছে।
বারবার হাজিরা এড়ানোর ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলে পুলিশি মহলে আলোচনা চলছে। আইনি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি তিনি সুস্থ হয়েও হাজিরা এড়ান, তাহলে পুলিশ পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতে পারে, যার মধ্যে আদালতের মাধ্যমে হাজিরা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
অডিওর সত্যতা নিয়ে AI-এর চাঞ্চল্যকর তত্ত্ব ও রাজনৈতিক চাপানউতোর
বিতর্কিত অডিও ক্লিপের সত্যতা নিয়ে অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা গগন সরকার একটি চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন, যা এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর অভিযোগ, এই অডিওটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে এবং এর পেছনে বিজেপি-র রাজনৈতিক চক্রান্ত রয়েছে। গগন সরকার প্রকাশ্যে দাবি করেছেন যে, ভয়েস ক্লোনিং বা ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তির কণ্ঠস্বর নকল করা সম্ভব এবং এটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর একটি নতুন কৌশল। এই AI তত্ত্ব বিতর্কে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং অডিওটির নিরপেক্ষ ফরেনসিক পরীক্ষার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
অন্যদিকে, এই কুকথার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস দ্রুত কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। দলের পক্ষ থেকে গত ৩০ মে, ২০২৫ তারিখে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করে অনুব্রত মণ্ডলের ব্যবহৃত ভাষার তীব্র নিন্দা করা হয় এবং তাকে চার ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। দলের কড়া অবস্থানের মুখে অনুব্রত ৩০ মে-তেই বোলপুর IC এবং তৃণমূল রাজ্য সভাপতির কাছে লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, দলের এক কর্মীর ছেলেকে পুলিশ মারধর করায় তিনি মেজাজ হারিয়েছিলেন। তবে, অডিও ফাঁস এবং তার সত্যতা নিয়ে তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা এখন AI তত্ত্বের সঙ্গে মিলেমিশে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিজেপি অবশ্য AI তত্ত্বকে ‘পালানোর অজুহাত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
পুলিশের পরবর্তী পদক্ষেপ: তদন্তের জটিলতা বাড়ছে
অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বারবার হাজিরা এড়ানোর ফলে পুলিশের উপর চাপ বাড়ছে। যেহেতু FIR-এর কিছু ধারা জামিন অযোগ্য, তাই পুলিশের পক্ষে দ্রুত তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- চিকিৎসার কাগজপত্র যাচাই: সূত্রের খবর, পুলিশ এখন অনুব্রত মণ্ডলের শারীরিক অবস্থা যাচাই করার জন্য তাঁর চিকিৎসার কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে পারে। এক্ষেত্রে, প্রয়োজনে নিরপেক্ষ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার আবেদনও করা হতে পারে।
- আইনি পরামর্শ: ক্রমাগত হাজিরা এড়ানোর প্রেক্ষিতে পুলিশ আইনি পরামর্শ নিচ্ছে। যদি অসুস্থতার কারণ যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত না হয় বা তিনি তদন্তে অসহযোগিতা করেন, তাহলে আদালতের মাধ্যমে তাঁকে হাজির করার জন্য পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
- ফরেনসিক রিপোর্টের অপেক্ষা: অডিওটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। AI তত্ত্বের দাবিকে কেন্দ্র করে এই রিপোর্টের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ফরেনসিক রিপোর্টই অডিওটি কৃত্রিমভাবে তৈরি কিনা, তা স্পষ্ট করবে।
এই মুহূর্তে, অনুব্রত মণ্ডলের হাজিরা না দেওয়া, AI তত্ত্বের দাবি এবং পুলিশের পরবর্তী পদক্ষেপ – এই তিনটি বিষয়ই তদন্তের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলছে। রাজনৈতিক মহলে এই ঘটনাকে ঘিরে তীব্র আলোচনা চলছে এবং জনমানসেও কৌতূহল বাড়ছে। অনুব্রত মণ্ডলের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং পুলিশের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হয়, সেদিকেই নজর রাখছে ওয়াকিবহাল মহল। এটি কেবল একটি কুকথা বিতর্ক নয়, বরং প্রযুক্তি, আইন এবং রাজনীতির এক জটিল মিশেল, যার পরিণতি দেখতে সবাই আগ্রহী।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে নতুন করে কী অভিযোগ উঠেছে?
একটি ভাইরাল অডিও ক্লিপে বোলপুর থানার IC-কে হুমকি ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, যা নিয়ে FIR দায়ের হয়েছে।
অনুব্রত মণ্ডল কি পুলিশের তলবে হাজিরা দিয়েছেন?
না, ২৮ মে, ২০২৫ থেকে শুরু করে ৪ জুন, ২০২৫ পর্যন্ত ৭ দিন পার হয়ে গেলেও তিনি এখনও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজিরা দেননি। তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়েছেন।
অনুব্রত ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা ভাইরাল অডিও সম্পর্কে কী দাবি করেছেন?
তিনি দাবি করেছেন যে ভাইরাল অডিও ক্লিপটি Artificial Intelligence (AI) প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে এবং এর পেছনে বিজেপি-র রাজনৈতিক চক্রান্ত রয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনায় কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
তৃণমূল কংগ্রেস অডিও ক্লিপের ভাষার তীব্র নিন্দা করেছে এবং অনুব্রত মণ্ডলকে চার ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অনুব্রত মণ্ডল দলের নির্দেশে ক্ষমা চেয়ে চিঠিও দিয়েছেন।
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে কী কী ধারায় মামলা রুজু হয়েছে?
ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর ২২৪, ১৩২, ৭৫ এবং IPC-র ৩৫১ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। এই ধারাগুলির মধ্যে কিছু জামিন অযোগ্য।
অনুব্রত মণ্ডলের বর্তমান শারীরিক অবস্থা কেমন?
তাঁর আইনজীবীদের মতে, অনুব্রত মণ্ডল তীব্র শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন এবং বর্তমানে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
AI দ্বারা অডিও তৈরির দাবিটি কি প্রমাণিত?
না, এই দাবিটি এখনো প্রমাণিত হয়নি। অডিওটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন।