রাস্তার এক কোণে, একটা লাইটপোস্টের নিচে বসে একটা ছেলে পড়ছিল।
তার পাশে একগাদা ভাঙা বই, ছেঁড়া খাতা। তার গায়ে স্কুল ইউনিফর্ম নেই, পায়ে জুতো নেই, হাতে কলমও আধাখানা।
তবু তার চোখে ছিল এমন এক আগুন, যা পুরো সমাজকে আলোকিত করার স্বপ্ন দেখত।
সে ছেলে কোনো দিন টিউশনে যায়নি।
তার বাবার আয় দিনে ৩০০ টাকা, তাও যদি কাজ থাকে।
রাতের খাবার কখনো জুটতো, কখনো শুধু জল খেয়ে ঘুম।
তবু সে পড়েছে — পাগলের মতো, স্বপ্নপাগলের মতো।
রাস্তার কুকুর পাশে শুয়ে থাকলেও, তার মন দৌড়াতো দিল্লির UPSC ভবনের দিকে।
আজ সে ছেলে অফিসার।
আজ সে ছেলেই থানার OC।
তার সামনে দাঁড়িয়ে পুরো গ্রাম স্যালুট করে।
এই গল্পটা শুধু একটা ছেলের গল্প নয়।
এই গল্পটা প্রতিটা সেই ছেলের গল্প,
যে প্রতিকূলতার ভিতর থেকেও স্বপ্ন দেখে —
আর সেই স্বপ্ন বাস্তব করে ফেলে… শুধু অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে।
জুতো ছেঁড়া, পেট খালি — কিন্তু চোখে ছিল আগুন
কখনও স্কুলের পেছনে, কখনও বাতির নিচে — ওর বই ছিল জ্বলন্ত লণ্ঠন
বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি, কিন্তু ছেলে স্বপ্ন দেখতো কোর্টরুমে বসার
সে ছেলেটার স্কুল ব্যাগটা ছিল প্লাস্টিকের থলে।
বৃষ্টির দিনে সেই ব্যাগে জল ঢুকে যেত, বইগুলো ভিজে গলে যেত।
তবু সে কোনোদিন অনুপস্থিত ছিল না ক্লাসে — যেন স্কুলই ছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি।
তার পায়ে কখনো জুতো ছিল না, কিন্তু মনের পায়ে ছিল লক্ষ্যভেদী ছোঁ।
যখন বন্ধুরা টিফিন আনত, সে চুপ করে দূরে বসে থাকত — তার টিফিন ছিল স্বপ্ন।
সন্ধ্যাবেলা যখন গ্রামে আলো নিভে যেত, সে তখন রাস্তার বাতির নিচে পড়তো।
পাশের চায়ের দোকানদার বলত, “এই ছেলেটার চোখে আগুন — এটা একদিন বড় হবে।”
তার বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি।
কাঁধে ইট বয়ে ফিরতেন, আর ছেলেকে বলতেন,
“তুই যেন কখনও আমার মতো শুধু রুটি-বুটির পেছনে জীবন না কাটাস।”
সেই কথাগুলো বুকের গর্তে ঢুকে গিয়েছিল।
সে পড়ত — আদালতের নিয়ম, সংবিধানের ধারা, ইতিহাসের লড়াই।
তাকে কেউ শেখায়নি, “আদালত মানে কি”, কিন্তু তার ভেতরে ছিল এক অদৃশ্য শিক্ষা —
যেটা বলে দেয়:
“আমার এখন কিছু নেই — কিন্তু একদিন এই ‘কিছু নেই’ থেকেই আমি অনেক কিছু হবো।”
দিনে কাজ, রাতে পড়া — থেমে না যাওয়ার শপথ
বাসন মাজা, দোকানদারি — প্রতিটি টাকা ছিল পরবর্তী পরীক্ষার জন্য
সকাল ৬টা।
পাড়া-প্রতিবেশী তখনো ঘুমে ঢুলছে, কিন্তু সে রুটি গুছিয়ে দিচ্ছে দোকানে। তারপর সোজা এক বাড়িতে, সেখানে বাসন মাজতে হবে। সেখান থেকে আবার ছোটার পালা — মুদি দোকানে হিসাব লিখবে।
২৫ টাকা, ৩০ টাকা, ৫০ টাকা — তার কাছে প্রতিটি টাকা মানে একেকটা সিঁড়ি, যেটা তাকে পৌঁছে দেবে আইএএস অফিসারের চেয়ারে।
সে জানত, বই কিনতে হবে। ফর্ম ফিলআপ করতে হবে। বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতি কিনতে হবে।
এই টাকাগুলোই ছিল তার অস্ত্র — দরিদ্রতার বিরুদ্ধে, ভাগ্যের বিরুদ্ধে।
মা বলতেন, ‘শরীর গরিব হতে পারে, মন নয়’ — সেই ছিল তার শক্তি
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরত সে — ধুলোমাখা পা, ক্লান্ত চোখ, কিন্তু বুকভরা আগুন।
মা তখন বলতেন, “শরীর গরিব হতেই পারে, কিন্তু মন যদি ধনী হয়, তোকে কেউ হারাতে পারবে না।”
এই কথাগুলোই তার ভেতরে সাহস জোগাত, যখন বন্ধুরা কোচিং করত আর সে পেট্রোলপাম্পে কাজ করত।
যখন বিদ্যুৎ থাকত না, সে মোমবাতির আলোয় পড়ত।
যখন ঘুম এসে যেত, মা বলতেন, “তোর ঘুম এখন নয়, তোর ঘুম একদিন লাল বাতির গাড়িতে আসবে।”
সে বিশ্বাস করত —
“দিনটা কষ্টের হোক, রাতটা ঘামে ভেজা হোক — কিন্তু স্বপ্ন যেন ধুলোমাখা না হয়।”
মক টেস্ট থেকে মেরিট লিস্ট — রোল নম্বরটা যেন গর্জে উঠল
ছোট গ্রাম থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে UPSC হলরুম
একটা সময় ছিল যখন তার গ্রামে ইন্টারনেট বলতে বোঝাত ‘লাগে না, ওই শহরের জিনিস’।
তবু সে খুঁজে বের করল পুরনো একটা ফোন। সেখানে মোবাইল ডেটার শেষ মেগাবাইট খরচ করে নোটস নামাত।
কোচিং তো দূরের কথা, বই-খাতা কেনাও ছিল বিলাসিতা।
তবু সে যেটুকু জোগাড় করতে পেরেছে — সেটা দিয়ে শুরু করল যুদ্ধ।
মক টেস্ট!
প্রথমবার উত্তরে “C” দাগাতে গিয়ে হাতে কাঁপুনি উঠছিল।
কিন্তু একদিন বুঝতে পারল, সঠিক উত্তর জানার চেয়ে বেশি দরকার আত্মবিশ্বাস।
কলকাতার একটা হলরুমে, নিঃশব্দে তার কলম চলছিল — পাশে হাজারো প্রতিযোগী, কিন্তু তার চোখে শুধু একটাই মুখ ভাসছিল — তার মায়ের।
সেদিন পুরো গ্রাম মিষ্টি খাচ্ছিল, শুধু সে চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল
UPSC-এর ফলাফল বেরোনোর দিন।
পুরো গ্রামে ঢাকঢোল না বাজলেও, কিছু একটা বাজছিল — সেটা ছিল আবেগের ঢেউ।
পাশের বাড়ির আন্টি মিষ্টি নিয়ে আসছিলেন, স্কুলের হেডস্যার ফোন করছিলেন, কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছিল।
কিন্তু সে?
সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। চুপচাপ। নিঃশব্দে।
তার চোখে জল ছিল না। মুখে হাসিও ছিল না।
শুধু বুকের ভেতরে একটা কণ্ঠস্বর বাজছিল —
“মা, আমি পেরেছি। এখন তুই একটু বিশ্রাম নিস।”
এখন সে থানার OC — অথচ মাটির গন্ধটা এখনো বুকের ভিতর
যেখান থেকে শুরু, সেখানেই সে বারবার ফিরে যায় — স্কুলের সেই ভাঙা বেঞ্চে
আজ সে থানার অফিসার ইন চার্জ — মানুষের সমস্যা শোনে, সলভ করে, সমাজকে রক্ষা করে।
কিন্তু সপ্তাহের একদিন ঠিকই সে একা সাইকেলে চেপে চলে যায় স্কুলের সেই পুরনো মাঠে।
একটা ঝুপড়ি ঘর, যেখানে ছাদের টিনে রোদ পড়লেই অক্ষর পড়া যেত না।
সেই বেঞ্চ, যেটাতে বসে সে প্রথমবার ‘ভারত আমার দেশ’ মুখস্থ করেছিল — আজও সেখানে ধুলো জমে।
তবু সে বসে পড়ে… চুপচাপ।
কারণ সে জানে, এই বেঞ্চই ছিল তার প্রথম পাথেয়, এই ঘরই ছিল তার প্রথম আদালত।
গরিব ছেলেদের হোস্টেল তৈরি করেছে — যেন আর কেউ বাতির নিচে না পড়ে
তার নিজের ছেলেবেলায় ছিল না স্টাডি ল্যাম্প, ছিল না টেবিল বা চেয়ার।
ছিল কেবল মাটির চাটাই আর একখানা মোমবাতি।
সেই অভিজ্ঞতাই তাকে চালনা করল।
তাই সে নিজের বেতন থেকে জমিয়ে, একটা হোস্টেল বানিয়েছে গ্রামের গরিব ছেলেদের জন্য।
নাম দিয়েছে — “আলোর ঘর”।
এখানে প্রতিটি ছেলেকে সে শেখায় —
“তোমার বাড়ি ছোট হতে পারে, কিন্তু স্বপ্নটা বিশাল হোক।”
গ্রামের লোকেরা বলে,
“ও এখন OC — কিন্তু এখনও মাটির গন্ধ ভুলে যায়নি।”.
FAQ – পাঠকদের মনে জাগা কিছু সাধারণ প্রশ্ন
ছেলেটি কোথা থেকে এসেছে?
সে এসেছিল এক অজপাড়া গ্রামের কুঁড়ে ঘর থেকে, যেখানে বর্ষায় ছাউনি চুঁইয়ে পড়ে, আর গরমে কুকুর ঘুমোয় মাটির চাটাইতে। ঠিকানার বদলে একসময় বলত: “বাতির নিচে বসি, ওখানেই থাকি।
তার বাবা-মা এখন কী করেন?
তার বাবা এখনও রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, সকালে একটা ঝাঁকাওলা ব্যাগে করে হাঁটেন নির্মাণ সাইটে।
মা প্রতিদিন গ্রামের বাজারে সবজি বিক্রি করেন — তবে এখন তাঁর চোখে এক অন্যরকম আলো, যেন বলছেন:
“আমার ছেলের জন্য এই গরিবিও এখন সোনার মতো দামি।”
সে কীভাবে কোচিং ছাড়া প্রস্তুতি নিয়েছিল?
পড়াশোনার সবকিছু ইউটিউব আর ফ্রি অ্যাপ থেকে শিখেছে। মোবাইল ছিল একটা ভাঙা স্ক্রিনের, কিন্তু ইচ্ছেটা ছিল কাঁচের মতো স্বচ্ছ।
নিজের তৈরি নোট, সরকারি গ্রন্থাগার, আর বাতির নিচের প্রতিজ্ঞাই ছিল তার কোচিং।
সমাজ বা সরকার সাহায্য করেছিল কি?
না, শুরুতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
সে সাহায্য পায়নি, কিন্তু হালও ছাড়েনি।
আজ যখন সে থানার OC, তখন অনেকেই পাশে আসছে — তবে তখন তার প্রয়োজন ছিল কেবল একটাই: আস্থা।
আর সেই আস্থার নাম ছিল: “মা”।
শেষ কথা: স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না — শুধু সাহস লাগে
বাতির নিচে বসে যে ছেলেটি পড়ত, তার চারপাশে তখন ছিল অন্ধকার, অভাব আর অবহেলা।
কিন্তু সে জানত — আলো কারো দয়া নয়, সেটা জ্বালাতে হয় সাহস দিয়ে।
আজ সে থানার অফিসার।
তার ঘরে এখন এসি চলে, সামনে ডেস্কে থাকে অনেক ফাইল —
তবু তার মন পড়ে থাকে সেই পুরনো মাটির ঘরে, যেখানে মা বলতেন:
“তুই মানুষ হ, ছেলে — অন্যের মুখে হাসি আনবি।”
এই লেখাটা কোনো ছেলেকে নিয়ে নয়,
এটা প্রতিটা মানুষের জন্য —
যে এখনো বিশ্বাস করে,
“আমিও পারি, যদি আমি নিজেকে বিশ্বাস করি।”
শেষে শুধু একটা লাইন মনে রেখে যান —
👉 “যে ছেলেটি বাতির নিচে পড়েছিল, এখন সে আলো জ্বালায় অন্যদের জন্য।”
Your comment will appear immediately after submission.