আজানের জবাব ও দোয়া — বাংলা অর্থসহ, নিয়ম ও ফজিলত

5/5 - (2 votes)

ইসলামের প্রতিটি দিকেই রয়েছে শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও উদ্দেশ্য। তারই এক মহান নিদর্শন হলো “আযান” — নামাজের ডাক, যা মুসলমানদের হৃদয়ে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দেয়।
প্রতিদিন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিরবচ্ছিন্নভাবে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় — যেন দুনিয়ার আকাশে আল্লাহর স্মরণ কখনো থামে না।

আযানের জবাব দেওয়া একটি প্রিয় সুন্নত। নবী করিম ﷺ বলেছেন,

Advertisements

“যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আহ্বান শুনবে, তখন যা সে বলে তোমরাও তাই বলো।”
(সহীহ মুসলিম: ৩৮৪)

এই জবাব কেবল একটি রীতি নয়; এটি আমাদের ঈমানের প্রকাশ, আত্মার প্রশান্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি সুন্দর উপায়।

আজানের জবাব কীভাবে দিতে হয় — সঠিক নিয়ম ও ধাপ

আযানের জবাব দেওয়া ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল। এটি কেবল একটি ধ্বনির উত্তর নয়, বরং আল্লাহর আহ্বানে হৃদয় দিয়ে সাড়া দেওয়া।

নবী করিম ﷺ বলেছেন —

“যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আওয়াজ শুনবে, তখন যা সে বলে, তোমরাও তাই বলো।”
(সহীহ বুখারী: ৬১১, সহীহ মুসলিম: ৩৮৩)

অর্থাৎ, আযানের প্রতিটি বাক্যের উত্তর মুয়াজ্জিনের মতোই বলা উচিত। এটি এমন এক ইবাদত, যার মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহর স্মরণে নিজেকে যুক্ত করে এবং নবীর নির্দেশ পালন করে।

আজানের জবাব দেওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ

আযানের জবাব দেওয়া মানে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ নয় — এটি ঈমানের জাগরণ।
যখন মুসলমান আযানের জবাব দেয়, তখন সে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেয়, নবীজির আনুগত্য স্বীকার করে এবং নামাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে।

📖 আল্লাহ বলেন:
“যখন নামাজের আহ্বান (আযান) দেয়া হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে ছুটে যাও।”
(সূরা জুমুআ: ৯)

সহজে মনে রাখার টিপস

  • “যা মুয়াজ্জিন বলে — তাই বলো।”
  • শুধু “হাইয়া…” শুনলে বলবে “লা হাওলা…”
  • ফজরের “আসসালাতু খাইরুম…” এ বলবে “সদাকতা ওয়া বররতা।”
  • শেষে দরুদ ও দোয়া পড়বে।

আযানের অর্থ ও ইসলামে এর গুরুত্ব

আযান শব্দটি এসেছে আরবি “أَذَان” (আযান) থেকে, যার অর্থ “ডাকা” বা “প্রকাশ করা”।
এটি কেবল নামাজের আহ্বান নয়, বরং আল্লাহর একত্ব ঘোষণা ও নবীর রিসালতের সাক্ষ্য।

প্রতিটি “আল্লাহু আকবার” আমাদের মনে করিয়ে দেয় — জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও আল্লাহই সর্বোচ্চ।
মুসলমানদের জীবনে আজান যেন একটি আত্মিক ঘড়ি, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়,

“এখন আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর সময়।”

“আমি ছোটবেলা থেকেই আজানের ধ্বনি শুনলেই শান্তি অনুভব করি — মনে হয়, সারা দুনিয়া যেন একসাথে আল্লাহর দিকে ফিরে যাচ্ছে।”

আযানের ইতিহাস ও সূচনা

প্রথম আজান কখন ও কিভাবে শুরু হয়েছিল

মদিনায় হিজরতের পর মুসলমানদের নামাজের জন্য আহ্বানের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রথমে প্রস্তাব আসে — ঢাক বাজানো, আগুন জ্বালানো বা শিঙ্গা ফুঁকানো হবে কিনা।
কিন্তু নবী করিম ﷺ স্বপ্নে একজন সাহাবীর (আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ রা.) দেখা অনুযায়ী “আযান” পদ্ধতি অনুমোদন করেন।
এভাবে শুরু হয় বিশ্বের প্রথম আযান।

হযরত বিলাল (রা.) — প্রথম মুআয্জিনের ভূমিকা

হযরত বিলাল (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। তাঁর কণ্ঠে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি যখন মদিনার আকাশে ভেসে উঠত, তখন মানুষের হৃদয়ে ঈমান জেগে উঠত।
তিনি ছিলেন দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া এক মহান সাহাবী, যাঁর নাম ইতিহাসে চিরকাল অমর থাকবে।

হাদিসে আজানের গুরুত্ব ও ফজিলত

নবী করিম ﷺ বলেছেন:

“মুয়াজ্জিনের আওয়াজ যেখানে পৌঁছে যায়, সেখানে পর্যন্ত যত জীবজন্তু ও জিন আছে, সবাই কিয়ামতের দিন তার জন্য সাক্ষ্য দেবে।”
(সহীহ বুখারী: ৬০৯)

আযানের জবাব দেওয়ার সঠিক নিয়ম

প্রতিটি বাক্যের জবাব একে একে

“Allahu Akbar” শুনলে কী জবাব দিতে হয়

আরবি: الله أكبر
উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার
অর্থ: আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।
মুয়াজ্জিন “আল্লাহু আকবার” বললে আপনিও একইভাবে উত্তর দিন।

“Ashhadu an la ilaha illallah” শুনলে কী জবাব দিতে হয়

আরবি: أشهد أن لا إله إلا الله
উচ্চারণ: আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।

“Ashhadu anna Muhammadar Rasulullah” শুনলে কী জবাব দিতে হয়

আরবি: أشهد أن محمدًا رسول الله
উচ্চারণ: আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রাসূল।

“Hayya ‘alas-salah” ও “Hayya ‘alal-falah” শুনলে কী জবাব দিতে হয় (H4)

আরবি: لا حول ولا قوة إلا بالله
উচ্চারণ: লা হাওলা ওয়ালা কুত্তা ইল্লা বিল্লাহ
অর্থ: আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তি ও ক্ষমতা নেই।

“As-salatu khairum minan-nawm” (ফজরের আযানে)

আরবি: صدقت و بررت
উচ্চারণ: সদাকতা ওয়া বররতা
অর্থ: তুমি সত্য বলেছো এবং উত্তম কাজ করেছো।

শেষে “La ilaha illallah” শুনলে কী জবাব দিতে হয়

আরবি: لا إله إلا الله
উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।

আযান শেষে পড়ার দোয়া (After Azan Dua)

সহিহ হাদিস অনুযায়ী আযানের দোয়া (Arabic + বাংলা অর্থসহ)

আরবি:
اللهم رب هذه الدعوة التامة والصلاة القائمة، آت محمداً الوسيلة والفضيلة، وابعثه مقاماً محموداً الذي وعدته

উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা রাব্বা হা-যিহিদ্ দা‘ওয়াতিত্ তাম্মাহ, ওয়াস্-সালাতিল্ ক্বা-ইমাহ, আ-তি মুহাম্মাদানিল্ ওয়াসীলাতা ওয়াল্ ফাদীলাহ, ওয়াব‘আছ্ হু মাক্বামাম মাহমুদানিল্লাযী ওয়া‘আদ্তাহু।

বাংলা অর্থ:
হে আল্লাহ! এই পরিপূর্ণ আহ্বান ও কায়েম নামাজের প্রতিপালক, মুহাম্মদ ﷺ-কে মধ্যস্থতা ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিন, এবং তাঁকে সেই প্রশংসিত স্থানে উত্তোলন করুন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি দিয়েছেন।

নবী করিম (সা.) এর বাণী ও ফজিলত

নবী করিম ﷺ বলেছেন:

“যে ব্যক্তি আযান শুনে এই দোয়া পাঠ করবে, আমার শাফাআতের অধিকারী হবে।”
(সহীহ মুসলিম: ৩৮৫)

আযানের জবাবের ফজিলত ও পুরস্কার

হাদিসে আযানের জবাবের মর্যাদা

আযানের জবাব দেওয়া এমন এক ইবাদত, যার মাধ্যমে মানুষ ফেরেশতাদের দোয়া লাভ করে।

“মুয়াজ্জিন ও তার জবাবদাতা উভয়েই ক্ষমা লাভ করে।” — (তিরমিজি)

আযানের জবাব দিলে যে সওয়াব পাওয়া যায়

প্রতিবার আজানের জবাব দিলে আল্লাহ তায়ালা বান্দার নাম আমলনামায় নথিভুক্ত করেন।
এটি এমন এক আমল, যা সহজ অথচ পরকালে বিশাল পুরস্কার বয়ে আনে।

আযানের জবাব দেওয়ার সময় কিছু সাধারণ ভুল

আযানের শব্দের ভুল উচ্চারণ

অনেকে “লা হাওলা…” অংশটি ভুল উচ্চারণ করেন, এতে অর্থ বিকৃত হয়। তাই সঠিক তাজবিদে উচ্চারণ করা জরুরি।

নামাজে বা কুরআন তেলাওয়াতের সময় জবাব

যদি কেউ নামাজে থাকে, তবে আযানের জবাব দেওয়া যাবে না — নামাজ শেষে পড়বে।
(সূত্র: ইসলামিকফাইন্ডার, ইসলামকিউএ)

আযানের জবাব থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও ইসলামিক বার্তা

আযানের জবাবের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত করা

আযান মানুষকে একবার নয়, বারবার আল্লাহর দিকে ডাক দেয় — যেন আমাদের হৃদয় সজাগ থাকে।

সমাজে ঐক্যের প্রতীক

একই ধ্বনিতে কোটি মুসলমানের সাড়া — এটি ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রতীক।

নিয়মিত আযানের জবাব দিলে ঈমান দৃঢ় হয়

নিয়মিত আযানের জবাব দেওয়া একজন মুসলমানের আত্মাকে প্রশান্ত করে এবং ঈমানকে শক্তিশালী করে।

উপসংহার — আযানের জবাব ও দোয়ার গুরুত্ব আমাদের জীবনে

আযানের জবাব আমাদের ঈমানের প্রতিধ্বনি। এটি এমন একটি আমল যা কোনো কষ্ট ছাড়াই বিশাল সওয়াব এনে দেয়।
তাই প্রতিবার আজান শুনলেই জবাব দিন, দোয়া পড়ুন এবং অন্যদের শেখান।

🕌 “আযানের জবাব ও দোয়া প্রতিদিন পড়ুন এবং অন্যদের শেখান। আপনি কি আজানের জবাব দেন? নিচে কমেন্টে জানান।”

আজানের জবাব সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর

আজান শোনার পর কিভাবে জবাব দিবো?

আজান শোনার পর, আপনাকে আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সঠিকভাবে জবাব দিতে হবে। প্রতিটি অংশের পরে নিচের মতো জবাব দিন:
আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর: “লায়লা হা ইল্লাল্লাহ”
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ: “মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ”
হায়্যা আলাস সালাহ: “লা হাওলা ওয়া লা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”
হায়্যা আলাল ফালাহ: “লা হাওলা ওয়া লা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”

আজানের জবাব কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আজান ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। এর সঠিক জবাব দিয়ে একজন মুসলিম আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন এবং ইবাদতসমূহে তার মনোযোগ নিবদ্ধ করতে সক্ষম হন। এটি একটি ধর্মীয় কর্তব্য ও সাওয়াব অর্জনের মাধ্যম।

আজানের জবাব না দিলে কি কিছু সমস্যা হবে?

যদিও আজানের জবাব না দেওয়া বড় পাপ নয়, তবে এটি ইসলামী নিয়ম-নীতি থেকে এক ধরনের অবহেলা হতে পারে। ইসলামে আল্লাহর আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে ধর্মীয় জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

আজানের সঠিক জবাব দেওয়ার জন্য কি কিছু দোয়া পড়তে হয়?

হ্যাঁ, আজানের পর সঠিক জবাব দেওয়ার পাশাপাশি একটি বিশেষ দোয়া রয়েছে যা বলা যায়:
“اللهم رب هذه الدعوة التامة والصلاة القائمة آتِ محمداً الوسيلة والفضيلة وابعثه مقاماً محموداً الذي وعدته” (আল্লাহুম্মা রাব্বা হাজিহি দাওয়া আত-তাম্মা ওয়াস সালাতি-কায়িমা আতি মুহাম্মাদান আল ওয়াসিলা ওয়াল ফাদিলা ওয়া বাড়িহু মকামান মাহমুদান আল্লাজি ওয়াদ্বাতাহু)
এই দোয়া পড়লে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে একে একে সাওয়াব পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আজানের জবাব দেওয়ার সময় কি কোনো ভুল করলে কি কিছু সমস্যা হয়?

যদি আজানের জবাব দেওয়ার সময় কিছু ভুল হয়ে যায়, তবে আল্লাহর কাছে তাওবা করে সঠিকভাবে আবার চেষ্টা করা উচিত। ইসলাম একটি সহনশীল ধর্ম, তাই ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে তা করার চেষ্টা করা উচিত।

আজানের সঠিক জবাব দিলে কি বিশেষ কোনো পুরস্কার পাওয়া যায়?

হ্যাঁ, আজানের সঠিক জবাব দিলে অনেক সাওয়াব পাওয়া যায়, এমনকি রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে, যারা আজানের পরে সঠিক জবাব দেয় এবং নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেয়, তাদের জন্য জান্নাতে বিশেষ স্থান বরাদ্দ হবে।

আজানের জবাব দেওয়ার মাধ্যমে কি শুধু নামাজের জন্য প্রস্তুতি হয়?

না, আজানের সঠিক জবাব দেয়ার মাধ্যমে শুধু নামাজের জন্য প্রস্তুতি হয় না, বরং এটি আল্লাহর সাথে সম্পর্কের উন্নতি, সাওয়াবের বৃদ্ধি এবং মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।

নামাজে থাকা অবস্থায় আযানের জবাব দেওয়া যায় কি?

না, নামাজে থাকা অবস্থায় জবাব দেওয়া যাবে না। নামাজ শেষে পড়া উচিত।

নারীরা কি আযানের জবাব দিতে পারে?

হ্যাঁ, নারীরাও আযানের জবাব দিতে পারেন — তবে নীরবে, অন্যদের শোনানোর জন্য নয়।

একাধিক মসজিদের আজান শুনলে কতবার জবাব দিতে হবে?

একবার জবাব দিলেই যথেষ্ট। তবে চাইলে প্রতিবার শুনে জবাব দিলে সওয়াব বাড়বে।

অতিরিক্ত তথ্য

কুরআন ও হাদিসের রেফারেন্স তালিকা

  • তিরমিজি শরীফ
  • সহীহ বুখারী: হাদিস ৬০৯
  • সহীহ মুসলিম: হাদিস ৩৮৪–৩৮৫
Advertisements
Farhat Khan

Farhat Khan

ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক

আমার সব আর্টিকেল

Your comment will appear immediately after submission.

মন্তব্য করুন