২৮শে এপ্রিল, ২০০৭ তারিখে বার্বাডোসের কেনসিংটন ওভালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। এই ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলঙ্কা।
টসে জিতে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন।
বৃষ্টির কারণে ম্যাচটি দেরিতে শুরু হওয়ায় ওভার সংখ্যা কমিয়ে ৩৮ করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট অসাধারণ ব্যাটিং করেন এবং ১০৪ বলে ১৪৯ রানের একটি বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন, যেখানে ১৩টি চার ও ৮টি ছক্কা ছিল। ম্যাথু হেইডেন ৩৮ এবং রিকি পন্টিং ৩৭ রান করেন। অস্ট্রেলিয়া নির্ধারিত ৩৮ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ২৮১ রানের বিশাল স্কোর তোলে। শ্রীলঙ্কার পক্ষে লাসিথ মালিঙ্গা দুটি উইকেট নেন।
অস্ট্রেলিয়ার স্কোরকার্ড: ২৮১ রান/৪ উইকেট ৩৮ ওভার
জবাবে ব্যাট করতে নেমে শ্রীলঙ্কার শুরুটা খুব একটা ভালো হয়নি। উপুল থারাঙ্গা দ্রুত আউট হয়ে যান। তবে সনাথ জয়াসুরিয়া (৬৩) এবং কুমার সাঙ্গাকারা (৫৪) একটি ভালো জুটি গড়েন। কিন্তু এই জুটি ভাঙার পর শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইনআপে ধস নামে। নিয়মিত ব্যবধানে উইকেট হারাতে থাকে তারা। বৃষ্টির কারণে ফের খেলা বন্ধ হলে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে শ্রীলঙ্কার নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৬ ওভারে ২৬৯ রান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নির্ধারিত ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ২১৫ রান করতে সক্ষম হয়। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে মাইকেল ক্লার্ক দুটি এবং নাথান ব্র্যাকেন, ব্র্যাড হগ ও শেন ওয়াটসন একটি করে উইকেট নেন।
শ্রীলঙ্কার স্কোরকার্ড: ২১৫ রান/৮ উইকেট/৩৬ ওভার
বৃষ্টি এবং আলোর স্বল্পতার কারণে ম্যাচটি কিছুটা নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। শেষদিকে যখন আলো কমে আসে, তখন আম্পায়াররা খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে আবার তিন ওভারের জন্য খেলা শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কা আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি।
অস্ট্রেলিয়া ৫৩ রানে জয়লাভ করে।
রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া দল মাহেলা জয়াবর্ধনের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কাকে ৫৩ রানে (বৃষ্টি আইনে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে) পরাজিত করে টানা তৃতীয়বারের মতো এবং মোট চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে।
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার বিস্ফোরক ১৪৯ রানের ইনিংসের জন্য ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
অস্ট্রেলিয়া এই বিশ্বকাপের একটিও ম্যাচ না হেরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। গ্লেন ম্যাকগ্রা টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
এই ফাইনাল ম্যাচটি অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস এবং বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জয় ক্রিকেট ইতিহাসে তাদের সোনালী যুগের সাক্ষ্য বহন করে।
এই ম্যাচের সেরা ৫টি মুহূর্ত
১. গিলক্রিস্টের গ্লাভস কৌশল: অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার ব্যাটের গ্রিপের নিচে একটি স্কোয়াশ বল রেখে ব্যাট করেছিলেন, যাতে তার হাতের অবস্থান ভালো থাকে এবং তিনি আরও শক্তিশালী শট খেলতে পারেন। এটি ছিল তার বিস্ফোরক ১৪৯ রানের ইনিংস খেলার পেছনের একটি গোপন কৌশল।
২. গিলক্রিস্টের বিধ্বংসী ১৪৯: এটি বিশ্বকাপের ফাইনালের ইতিহাসে কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। ১০৪ বলে ১৪৯ রানের এই বিধ্বংসী ইনিংসটিই অস্ট্রেলিয়ার বিশাল স্কোরের ভিত্তি স্থাপন করে এবং কার্যত শ্রীলঙ্কার জয়লাভের আশা শেষ করে দেয়।
৩. জয়াসুরিয়া-সাঙ্গাকারার প্রতিরোধ: বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শ্রীলঙ্কার দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান সনাথ জয়াসুরিয়া ৬৩ এবং কুমার সাঙ্গাকারা ৫৪ ১২২ রানের একটি লড়াকু জুটি গড়েন, যা কিছু সময়ের জন্য শ্রীলঙ্কার জয়ের আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল।
৪. ম্যাকগ্রার বিদায়ী পারফরম্যান্স: গ্লেন ম্যাকগ্রার এটি ছিল শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ। যদিও তিনি কোনো উইকেট পাননি, তবে তার কিপটে বোলিং শ্রীলঙ্কার উপর চাপ তৈরি করে। টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য তিনি ‘প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ পুরস্কার জেতেন, যা তার বিদায়ী বিশ্বকাপের জন্য একটি স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল।
৫. আলোর স্বল্পতার বিতর্ক: ম্যাচের শেষদিকে যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখন আম্পায়াররা ভুলবশত খেলা শেষ ঘোষণা করেন। পরে তাদের ভুল শুধরে নেওয়া এবং পুনরায় খেলা শুরু করার সিদ্ধান্তটি নাটকীয়তার সৃষ্টি করে। অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়দের উদযাপন ভঙ্গ করে আবার মাঠে ফেরা এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচ শেষ হওয়া – এটি ফাইনালটির সবচেয়ে আলোচিত বিতর্কিত ও নাটকীয় মুহূর্ত ছিল।
FAQs (বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী)
এই ম্যাচের সবচেয়ে বিতর্কিত মুহূর্ত কোনটি ছিল?
ফাইনাল ম্যাচের সবচেয়ে বিতর্কিত মুহূর্তটি এসেছিল আলোর স্বল্পতার কারণে। যখন শ্রীলঙ্কার স্কোর ৩৩ ওভারে ২০৬ রান ও ৭ উইকেট ছিল, তখন আম্পায়াররা ঘোষণা করেন যে আলো স্বল্পতার কারণে খেলা শেষ, এবং অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়েরা উল্লাস শুরু করেন। কিন্তু পরে জানা যায় যে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে এখনও তিন ওভার খেলা বাকি আছে এবং শ্রীলঙ্কা তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে অলআউট হয়নি। আম্পায়াররা ভুল স্বীকার করেন এবং অন্ধকার হয়ে যাওয়া মাঠেই খেলাটি শেষ করার জন্য পুনরায় শুরু করেন, যা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম একটি নাটকীয় ও বিব্রতকর সমাপ্তি তৈরি করেছিল।
এই জয়ের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া মোট কতগুলি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল?
এই জয়ের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া মোট চতুর্থবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে। এর আগে তারা ১৯৮৭, ১৯৯৯ এবং ২০০৩ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল। এটি ছিল তাদের টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়।
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার বিধ্বংসী ইনিংসের সময় ব্যাটে স্কোয়াশ বল ব্যবহার করার বিষয়টি কখন প্রকাশ করেছিলেন?
গিলক্রিস্ট ফাইনাল ম্যাচ জেতার পরেই তার এই কৌশলটি প্রকাশ করেছিলেন। ম্যাচের পর প্রেজেন্টেশন সেরিমনিতে তিনি তার গ্লাভসের ভেতরের স্কোয়াশ বলটি দেখান, যা সেই সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
২০০৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া কি কোনো ম্যাচে পরাজিত হয়েছিল?
না। রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া দল এই বিশ্বকাপের একটিও ম্যাচ না হেরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এটি তাদের আধিপত্যের প্রমাণ বহন করে।
এই ফাইনালটি কোন দুটি দেশের মধ্যে বিশ্বকাপ প্রতিদ্বন্দ্বিতার শেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল?
অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বকাপ ম্যাচগুলোতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ফাইনালে শ্রীলঙ্কা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল, এবং এরপর ২০০৩ ও ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল বা গুরুত্বপূর্ণ ধাপে শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করে। ২০০৭ সালের ফাইনাল ছিল এই দুই দলের বিশ্বকাপ প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি স্মরণীয় শেষ অধ্যায়।
Your comment will appear immediately after submission.