২০২৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল, ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত ম্যাচগুলির মধ্যে একটি, অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৩ সালের ১৯শে নভেম্বর, রবিবার। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে এই মহারণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাগতিক ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে এই লড়াই দেখার জন্য স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ ছিল, যেখানে লক্ষ লক্ষ দর্শকের উল্লাস এবং কোটি কোটি ভক্তের আশা মিশে ছিল।
ম্যাচের শুরুতে, অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স টসে জিতে ভারতকে প্রথমে ব্যাট করার আমন্ত্রণ জানান।
পুরো টুর্নামেন্টে ভারতীয় দলের দুর্দান্ত ব্যাটিং পারফর্মেন্সের কারণে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছিল কোটি কোটি ভারতীয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সুপরিকল্পিত বোলিংয়ের সামনে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ শুরু থেকেই চাপে পড়ে।
ওপেনার রোহিত শর্মা স্বভাবসিদ্ধ আক্রমণাত্মক মেজাজে শুরু করলেও, ইনিংস দীর্ঘ করতে পারেননি। শুভমান গিলও এদিন ব্যর্থ হন। এরপর বিরাট কোহলি এবং কে এল রাহুল একটি জুটি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, কিন্তু রানের গতি ছিল ধীর। বিরাট কোহলি একটি ধৈর্যশীল ইনিংস খেললেও, বড় স্কোরে পৌঁছানোর আগেই তিনি আউট হয়ে যান। কে এল রাহুলও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন, তবে তিনিও ইনিংসের মোড় ঘোরাতে পারেননি।
অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা এদিন ছিলেন দুরন্ত ফর্মে। মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউড এবং প্যাট কামিন্সের ত্রয়ী ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের উপর ক্রমাগত চাপ বজায় রাখেন। তাদের নিখুঁত লাইন ও লেন্থের বোলিং এবং অসাধারণ ফিল্ডিংয়ের কারণে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা রানের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে থাকেন। মিডল অর্ডারেও কোনো বড় জুটি না হওয়ায় এবং শেষদিকে দ্রুত রান তোলার চেষ্টায় একের পর এক উইকেট হারাতে থাকায়, ভারত নির্ধারিত ৫০ ওভারে মাত্র ২৪০ রানে অল আউট হয়ে যায়।
ভারত স্কোরকার্ড
ব্যাটার | রান | বল | ৪ | ৬ | স্ট্রাইক রেট | আউট হওয়ার ধরন |
রোহিত শর্মা (C) | ৪৭ | ৩১ | ৪ | ৩ | ১৫১.৬১ | ক্যাচ – ট্র্যাভিস হেড, বোল্ড – গ্লেন ম্যাক্সওয়েল |
শুভমান গিল | ৪ | ৭ | ০ | ০ | ৫৭.১৪ | ক্যাচ – অ্যাডাম জাম্পা, বোল্ড – মিচেল স্টার্ক |
বিরাট কোহলি | ৫৪ | ৬৩ | ৪ | ০ | ৮৫.৭১ | বোল্ড – প্যাট কামিন্স |
শ্রেয়াস আইয়ার | ৪ | ৩ | ১ | ০ | ১৩৩.৩৩ | ক্যাচ – জশ ইংলিস, বোল্ড – প্যাট কামিন্স |
কে এল রাহুল (WK) | ৬৬ | ১০৭ | ১ | ০ | ৬১.৬৯ | ক্যাচ – জশ হেজলউড, বোল্ড – মিচেল স্টার্ক |
রবীন্দ্র জাদেজা | ৯ | ২২ | ০ | ০ | ৪০.৯০ | ক্যাচ – জশ ইংলিস, বোল্ড – জশ হেজলউড |
সূর্যকুমার যাদব | ১৮ | ২৮ | ১ | ০ | ৬৪.২৯ | ক্যাচ – জশ ইংলিস, বোল্ড – জশ হেজলউড |
মহম্মদ শামি | ৬ | ১০ | ১ | ০ | ৬০.০০ | ক্যাচ – অ্যাডাম জাম্পা, বোল্ড – মিচেল স্টার্ক |
জসপ্রীত বুমরাহ | ১ | ৩ | ০ | ০ | ৩৩.৩৩ | এলবিডব্লিউ – অ্যাডাম জাম্পা |
কুলদীপ যাদব | ১০ | ১৮ | ০ | ০ | ৫৫.৫৫ | রান আউট – প্যাট কামিন্স |
মহম্মদ সিরাজ | ৯* | ৮ | ১ | ০ | ১১২.৫০ | নট আউট |
অতিরিক্ত: ১৮ (লেগ বাই-৮, ওয়াইড-৯, নো-বল-১) মোট রান: ২৪০ (৫০ ওভারে ১০ উইকেট)
পতন হওয়া উইকেট: ১-৩০ (গিল), ২-৭৬ (রোহিত), ৩-৮১ (শ্রেয়াস), ৪-১৪৮ (কোহলি), ৫-১৭৩ (জাদেজা), ৬-২০৩ (রাহুল), ৭-২১৮ (শামি), ৮-২১৪ (বুমরাহ), ৯-২৩০ (কুলদীপ), ১০-২৪০ (সূর্যকুমার)
অস্ট্রেলিয়া বোলিং
বোলার | ওভার | মেডেন | রান | উইকেট | ইকোনমি |
মিচেল স্টার্ক | ১০ | ০ | ৫৫ | ৩ | ৫.৫০ |
জশ হেজলউড | ১০ | ০ | ৬০ | ২ | ৬.০০ |
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল | ৬ | ০ | ৩৫ | ১ | ৫.৮৩ |
প্যাট কামিন্স | ১০ | ০ | ৩৪ | ২ | ৩.৪০ |
অ্যাডাম জাম্পা | ১০ | ০ | ৪৪ | ১ | ৪.৪০ |
মিচেল মার্শ | ২ | ০ | ৫ | ০ | ২.৫০ |
ট্র্যাভিস হেড | ২ | ০ | ৪ | ০ | ২.০০ |
- ভারত স্কোরকার্ড : ২৪০ রান/১০ উইকেট/৫০ ওভার
জবাবে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়াও শুরুতে ধাক্কা খায়। মহম্মদ শামির অসাধারণ বোলিংয়ের সৌজন্যে তারা দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে (৪৭ রানে ৩ উইকেট)। তবে এখান থেকেই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন ট্র্যাভিস হেড এবং মার্নাস ল্যাবুশেন। এই জুটি ঠান্ডা মাথায় এবং অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যাটিং করে ভারতীয় বোলারদের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে দেন।
ট্র্যাভিস হেড এদিন ব্যাট হাতে ছিলেন অনবদ্য। তিনি একের পর এক দৃষ্টিনন্দন শট খেলেন এবং ভারতীয় ফিল্ডারদের কোনো সুযোগ দেননি। মার্নাস ল্যাবুশেনও ধৈর্য ধরে তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতক হাঁকান। তাদের দীর্ঘ পার্টনারশিপ ভারতের জয়ের স্বপ্ন কার্যত শেষ করে দেয়।
ট্র্যাভিস হেড ১৩৭ রানের একটি অসাধারণ শতরান করেন, যা অস্ট্রেলিয়ার জয়ের ভিত্তি স্থাপন করে। ল্যাবুশেন ৫৮ রানের একটি মূল্যবান ইনিংস খেলেন। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ৪৩ ওভারে মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।
অস্ট্রেলিয়া স্কোরকার্ড
ব্যাটার | রান | বল | ৪ | ৬ | স্ট্রাইক রেট | আউট হওয়ার ধরন |
ডেভিড ওয়ার্নার | ৭ | ৩ | ১ | ০ | ২৩৩.৩৩ | ক্যাচ – বিরাট কোহলি, বোল্ড – মহম্মদ শামি |
ট্র্যাভিস হেড | ১৩৭ | ১২০ | ১৫ | ৪ | ১১৪.১৭ | ক্যাচ – শুভমান গিল, বোল্ড – মহম্মদ সিরাজ |
মিচেল মার্শ | ১৫ | ১৫ | ১ | ১ | ১০০.০০ | ক্যাচ – কে এল রাহুল, বোল্ড – জসপ্রীত বুমরাহ |
স্টিভ স্মিথ | ৪ | ৯ | ১ | ০ | ৪৪.৪৪ | এলবিডব্লিউ বোল্ড – জসপ্রীত বুমরাহ |
মার্নাস ল্যাবুশেন | ৫৮* | ১১০ | ৪ | ০ | ৫২.৭৩ | নট আউট |
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল | ২* | ১ | ০ | ০ | ২০০.০০ | নট আউট |
অতিরিক্ত: ১৮ (লেগ বাই-৩, ওয়াইড-১১, বাই-৪) মোট রান: ২৪১ (৪৩ ওভারে ৪ উইকেট)
পতন হওয়া উইকেট: ১-১৬ (ওয়ার্নার), ২-৪১ (মার্শ), ৩-৪৭ (স্মিথ), ৪-২৩৯ (হেড)
ভারত বোলিং
বোলার | ওভার | মেডেন | রান | উইকেট | ইকোনমি |
জসপ্রীত বুমরাহ | ৯ | ২ | ৪৩ | ২ | ৪.৭৭ |
মহম্মদ শামি | ৭ | ১ | ৪৭ | ১ | ৬.৭১ |
রবীন্দ্র জাদেজা | ১০ | ০ | ৪৩ | ০ | ৪.৩০ |
কুলদীপ যাদব | ১০ | ০ | ৫৬ | ০ | ৫.৬০ |
মহম্মদ সিরাজ | ৭ | ০ | ৪৫ | ১ | ৬.৪২ |
- অস্ট্রেলিয়া স্কোরকার্ড: ২৪১ রান/৪ উইকেট/৪৩ ওভার
- অস্ট্রেলিয়া ৪২ বল ৬ উইকেটে জয়লাভ করে।
এই জয়ের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ইতিহাসে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ আরও একবার দিল। ষষ্ঠবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে তারা দেখিয়ে দিল কেন তারা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি। অন্যদিকে, ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন অধরা থেকে যাওয়ায় ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয় ভেঙে যায়। স্টেডিয়ামের পিনপতন নীরবতা এবং খেলোয়াড়দের মুখের হতাশার ছবি সেই স্বপ্নভঙ্গের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে।
ট্র্যাভিস হেড তার ম্যাচ জেতানো অনবদ্য ইনিংসের জন্য ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
বিরাট কোহলি পুরো টুর্নামেন্টে ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ের জন্য প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন।
২০২৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য একটি হতাশাজনক পরিণতি নিয়ে এলেও, ক্রিকেট বিশ্বের কাছে এটি ছিল একটি রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের সাক্ষী। ভারতের ব্যাটিং ব্যর্থতা যেমন আলোচনায় থাকবে, তেমনই অস্ট্রেলিয়ার অদম্য মানসিকতা এবং ট্র্যাভিস হেডের বীরত্বপূর্ণ ইনিংস দীর্ঘকাল ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই ফাইনাল ২০২৩ সালের ১৯শে নভেম্বর তারিখে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
Your comment will appear immediately after submission.