শচীন রমেশ তেন্ডুলকর, শুধু একটি নাম নয়, এটি একটি আবেগ, একটি বিশ্বাস, কোটি কোটি ভারতবাসীর হৃদস্পন্দন। ক্রিকেট বিশ্বে তিনি ‘লিটল মাস্টার’ বা ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ নামেই সমধিক পরিচিত। মুম্বাইয়ের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৭৩ সালের ২৪শে এপ্রিল তাঁর জন্ম। বাবা রমেশ তেন্ডুলকর ছিলেন একজন মারাঠি ঔপন্যাসিক ও মা রজনী তেন্ডুলকর বীমা কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। শচীনের নামকরণ করা হয় বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেববর্মণের নামে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ ছিল এবং এই আগ্রহই তাঁকে বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে এক কিংবদন্তীর আসনে বসিয়েছে।
শচীনের ক্রিকেট জীবনের শুরুটা হয় তাঁর কোচ রমাকান্ত আচরেকরের হাত ধরে। আচরেকরের কঠোর প্রশিক্ষণ এবং শৃঙ্খলাপরায়ণতাই শচীনকে ভবিষ্যতের কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল। কিশোর বয়সেই তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন এবং ১৯৮৮ সালে হ্যারিস শিল্ড আন্তঃস্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বিনোদ কাম্বলির সাথে ৬৬৪ রানের অবিস্মরণীয় জুটি গড়েন। এই ইনিংসটিই জাতীয় স্তরে তাঁর আগমন বার্তা দেয়।
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে করাচিতে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে ওয়াকার ইউনিসের বাউন্সারে নাক ফেটে যাওয়া সত্ত্বেও শচীনের দৃঢ় মনোবল এবং ব্যাটিং দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। সেই শুরু, তারপর দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের ব্যাটিং স্তম্ভ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
টেস্ট ক্রিকেটে পারফরম্যান্স
বিষয় | তথ্য |
---|---|
ম্যাচ | ২০০ |
ইনিংস | ৩২৯ |
রান | ১৫৯২১ |
সর্বোচ্চ স্কোর | ২৪৮ |
গড় রান | ৫৩.৭৮ |
প্লেয়ার অফ দ্যা ম্যাচ | ১৪ |
শতরান | ৫১ |
অর্ধশতক | ৬৮ |
চার | ২০৫৮ |
ছক্কা | ৬৯ |
ক্যাচ | ১১৫ |
ওয়ানডে (ODI) ক্রিকেটে পরিসংখ্যান
বিষয় | তথ্য |
---|---|
ম্যাচ | ৪৬৩ |
ইনিংস | ৪৫২ |
রান | ১৮,৪২৬ |
সর্বোচ্চ স্কোর | ২০০ |
গড় রান | ৪৪.৮৩ |
স্ট্রাইক রেট | ৮৬.২৩ |
শতরান | ৪৯ |
অর্ধশতক | ৯৬ |
চার | ২০১৬ |
ছক্কা | ২৯৫ |
ক্যাচ | ১৪০ |
প্লেয়ার অফ দ্যা ম্যাচ | ৬২ |
টি-টোয়েন্টি (T20I) ক্রিকেটে পরিসংখ্যান
বিষয় | তথ্য |
---|---|
ম্যাচ | ১ |
ইনিংস | ১ |
রান | ১০ |
সর্বোচ্চ স্কোর | ১০ |
গড় রান | ১০. ০০ |
স্ট্রাইক রেট | ১৩৩.৩৩ |
শতরান | ০ |
অর্ধশতক | ০ |
চার | ২ |
ছক্কা | ০ |
ক্যাচ | ১ |
প্লেয়ার অফ দ্যা ম্যাচ | ০ |
আইপিএল (IPL) পরিসংখ্যান
বিষয় | তথ্য |
---|---|
দল | মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের(MI) |
ম্যাচ | ৭৮ |
ইনিংস | ৭৮ |
রান | ২৩৩৮ |
সর্বোচ্চ স্কোর | ১০০ |
শতক | ১ |
অর্ধশতক | ১৩ |
গড় রান | ৩৪. ৮৩ |
স্ট্রাইক রেট | ১১৯. ৮২ |
চার | ২৯৫ |
ছক্কা | ২৯ |
ক্যাচ | ২৩ |
প্লেয়ার অব দ্যা ম্যাচ | ৮ |
অরেঞ্জ ক্যাপ | ১ বার ২০১০ সালে |
অধিনায়ক হিসেবেও শচীন ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি দলের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও অধিনায়ক হিসেবে তাঁর রেকর্ড খুব উজ্জ্বল নয়, তবে একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি বরাবরই দলের প্রধান ভরসা ছিলেন।
শচীনের ক্রিকেট জীবনে বহু স্মরণীয় ইনিংস রয়েছে। ১৯৯৮ সালে শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর দুটি অসাধারণ শতরান (ডেজার্ট স্টর্ম ইনিংস) আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিরুদ্ধে করা অপরাজিত ১৪০ রানের ইনিংসটি ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্তেও তাঁর পেশাদারিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এছাড়াও, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর ৯৮ রানের ইনিংসটি বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে শচীন অত্যন্ত শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের। ১৯৯৫ সালে অঞ্জলি তেন্ডুলকরের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। অঞ্জলি পেশায় একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁদের দুটি সন্তান রয়েছে – কন্যা সারা এবং পুত্র অর্জুন। অর্জুনও এখন ক্রিকেটের জগতে পা রেখেছেন।
শচীন তেন্ডুলকর শুধু মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েই নয়, মাঠের বাইরের আচরণ দিয়েও সকলের মন জয় করে নিয়েছেন। তাঁর বিনয়, নম্রতা এবং দেশপ্রেম তাঁকে এক আদর্শে পরিণত করেছে। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন।
ক্রিকেট বিশ্বে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বহু পুরষ্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে অর্জুন পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে রাজীব গান্ধী খেলরত্ন পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১২ সালে তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন এবং ২০১৩ সালে তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করা হয়। ভারতরত্ন পাওয়া প্রথম ক্রিকেটার এবং সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি তিনিই।
২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁর শেষ টেস্ট ম্যাচটি ছিল এক আবেগঘন মুহূর্ত। সারা বিশ্ব থেকে ক্রিকেটপ্রেমীরা সেদিন সাক্ষী ছিলেন এক কিংবদন্তীর বিদায়বেলার। শচীনের দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য ক্রিকেট জীবন বহু প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি শুধু একজন ক্রিকেটার নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি কিংবদন্তী যাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ক্রিকেটের ইতিহাসে।