সে ছোট্ট ছেলেটি…
জুতো ছিল না পায়ে, শুধু একটা মোটা সুতোর ফাঁস দিয়ে বাঁধা চপ্পল।
তার একটা পা-ও ছিল না — কিন্তু ছিল একটা স্কুল ব্যাগ আর তাতে গুঁজে রাখা কল্পনার খাতা।
প্রতিদিন দুই কিলোমিটার রাস্তা, ধুলো-মাটি, ইঁট-খোয়া আর পাহাড়ি পিচের গায়ে ঘষে ঘষে সে হাঁটত।
না, সে দৌড়াতে পারত না — কিন্তু তার চোখে আগুন ছিল।
যেখানে অনেকেই হাল ছেড়ে দেয় “পারে না” বলে,
সে সেখানে দাঁড়িয়ে বলেছিল — “আমি এক পায়েই এগিয়ে যাবো!”
এই গল্প কোনো কল্পকথা নয়,
এটি একটি ছেলের যন্ত্রণা, সাহস, অপমান আর তবুও প্রতিদিন চলার গল্প।
এক পা হারিয়েও, সে আমাদের দেখিয়ে দিল — মানুষের সাহস থাকলে, শরীর বাধা হতে পারে না।
এই লেখাটি শুধু একটি প্রতিবন্ধী শিশুর কথা নয় —
এই লেখাটি তাদের জন্য যারা শত অভাবেও হাল ছাড়তে চায় না,
এই লেখাটি তাদের জন্য যারা আজও প্রশ্ন করে —
“আমি কি পারবো?”
জবাব একটাই —
“তোমার একটা পা নেই? সমস্যা নেই — একটা স্বপ্ন তো আছে!”
প্রতিদিন দুপুরের পরেও চলত সফর — দুই কিলোমিটার এক পায়ে
পায়ে জর্জরিত বাবার রিকশা-যাত্রার গল্প — তার প্রথম কাঁধ
ছেলেটি জানত, তার পা নেই — কিন্তু তার বাবার ঘামে ছেলের চলার রাস্তাটা আঁকা ছিল।
বাবা রিকশা চালাতেন শহরের গলিতে গলিতে। প্রতিদিন স্কুল ছুটি হলে ছেলেটি স্কুলব্যাগ হাতে নিয়ে হাঁটত, কারণ বাবার রিকশা কখনও নিজের সন্তানের জন্য থামাতে পারেনি — কষ্টই ছিল তার উপহার।
এই ছেলেটির জীবনের প্রথম ‘বাহন’ ছিল তার বাবার ঘাম, আর সাহসের জোড়া চাকা।
ঝরাঝর পতিত রাস্তা, এক পা দিয়ে স্বপ্নের যাত্রা
দুই কিলোমিটার রাস্তা মানে শুধু দূরত্ব নয় — প্রতিদিন হার না মানার যুদ্ধ।
যেখানে অনেকে এক ধাক্কা খেলেই থেমে যায়, সেখানে সে এক পায়ে ভারসাম্য রেখে চলেছে।
কখনও রাস্তার পাশে লোক হেসেছে, কখনও দৃষ্টির তিরে আঘাত পেয়েছে — কিন্তু সে থামেনি।
তার চোখে তখন একটাই গন্তব্য — স্কুলের বেঞ্চ, যেখানে স্বপ্ন বইয়ের পাতায় অপেক্ষা করে।
শিক্ষার জন্য সাহস — প্রতিটি পা ফেলেই শিখেছে হাঁটা
সাহায্য বলতে কিছু ছিল না — তাই রোজ নির্দিষ্ট সময়েই স্কুলে যেত
সে জানত, কেউ তাকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যাবে না।
বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল দুই কিলোমিটার — কিন্তু সাহসের দূরত্ব ছিল অনেক বেশি।
একটা পা, ভাঙা স্যান্ডেল, আর একটা বইভর্তি ব্যাগ — এটাই ছিল তার পথচলার সম্বল।
বৃষ্টি হোক বা কুয়াশা, প্রতিদিন ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে সে স্কুলে পৌঁছে যেত। কারণ সে জানত, সময়ের চেয়ে বড় কিছু নেই, আর স্কুল মানেই ছিল ভবিষ্যতের দরজা।
বন্ধুরা উঠে দাড়ায়, সে শুধু এক পা দিয়ে হেসে এগিয়ে যায়
প্রতিদিনের ক্লাসে বন্ধুরা দাঁড়িয়ে বই পড়ে, দৌড়ে খেলাধুলা করে।
সে হয়তো দাঁড়াতে পারে না — কিন্তু তার হাসিটা দাঁড়িয়ে থাকে।
এক পা দিয়ে যখন হেঁটে ক্লাসে ঢোকে, তখন কেউ কিছু বলে না — কারণ তার হাঁটাটা একরকম নীরব ভাষণ।
হয়তো সে দৌড়াতে পারে না, কিন্তু সে সবার চেয়ে আগেই পৌঁছায় স্বপ্নের কাছাকাছি।
ভিডিও ভাইরাল, দানে আগ্রহ — সমাজ দেখল তার দৃঢ়তা
মোবাইল ক্যামেরার ভিতর নিজের লড়াই দেখল দেশ
ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজেছে। সবাই দৌড়ে চলে যাচ্ছে বাড়ির পথে।
আর তখন এক শিশুর ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় — এক পায়ে, ব্যাগ কাঁধে, রোদে-ধুলোয় ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে স্কুল থেকে বাড়ি।
শুরুতে কেউ হাসল, কেউ কাঁদল… কিন্তু আস্তে আস্তে সবাই থমকে দাঁড়াল।
একজন লেখে, “আমার দুই পা আছে, কিন্তু সাহস এতটুকু নেই।”
আরেকজন শেয়ার করে, “এটাই তো আসল শিক্ষা — জীবনের পাঠ।”
Jaipur Foot USA–র কাছে ‘কৃত্রিম পা’র আবেদন জাগল
এই ভিডিও দেখে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর চোখেও আসে সেই প্রতিভা।
Jaipur Foot USA এগিয়ে আসে — বলে,
“এই ছেলেটিকে আমরা তার হারানো পা ফেরাতে চাই।”
না, সেটি শুধুই একটি কৃত্রিম পা নয় — সেটি ছিল স্বাধীনতার প্রতীক।
কারণ এবার সে শুধু হেঁটে যাবে না, দৌড়াবে… সোজা তার স্বপ্নের দিকে।
এখন সে সেড়ি আঁকে ক্যানভাসে — আর প্রতিভার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে
স্কুল বই সেলাই নয়, পেনে আঁকা গল্প
পড়াশোনার খাতা একসময় তার জন্য ছিল শুধুই অক্ষরের বাহন।
কিন্তু এখন?
তার হাতে উঠে এসেছে কলম আর তুলি — আর প্রতিটি আঁচড়ে তৈরি হচ্ছে গল্প।
সে জানে, শব্দ সবাই লেখে। কিন্তু সে ছবি আঁকে — যেখানে চোখেই লেখা থাকে সাহসের পদচিহ্ন।
সাহস তার ছবি – যেখানে প্রতিটি রেখা হয়ে উঠেছে এক ইতিহাস
আজ তার আঁকা ছবি শুধু রঙে ভরা নয় — প্রতিটি লাইনেই আছে কষ্ট, লড়াই আর জয়ের চিহ্ন।
এক পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া সেই ছেলে, আজ প্রদর্শনীতে দাঁড়িয়ে দর্শকদের প্রশ্ন করে —
“তোমার স্বপ্নটাকে তুমি কতদূর নিয়ে যেতে চাও?”
কারণ সে জানে, প্রতিটি প্রতিকূলতা আসলে ক্যানভাসের একটা দাগ — যা একদিন হয়ে উঠবে শিল্প।
FAQ – জাগে এমন সাধারণ প্রশ্ন
পারভেইজ আজ কোথায়?
পারভেইজ বর্তমানে তার নিজ গ্রামের সরকারি স্কুলেই পড়ছে। সে এখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তার উপস্থিতি এবং পারফরম্যান্স শিক্ষকদের মন জয় করেছে।
কৃত্রিম পা পেয়েছে কি?
হ্যাঁ, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ‘Jaipur Foot USA’ ও স্থানীয় কিছু সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান তার পাশে দাঁড়ায়। বর্তমানে পারভেইজ একটি উন্নত কৃত্রিম পা ব্যবহার করছে, যা তার চলাফেরায় অনেক সুবিধা এনে দিয়েছে।
সে কী ভবিষ্যতে কী করতে চায়?
পারভেইজ ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসে। সে এখন বলে, “আমি বড় হয়ে একজন আর্টিস্ট হতে চাই, যেন আমার ছবিতেই মানুষ সাহস খুঁজে পায়।” তার স্বপ্নের মাঝে শুধু ক্যারিয়ার নয় — আছে অনুপ্রেরণার শক্তিও।
সমাজ বা সরকার কী সাহায্য করলো?
ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর প্রশাসনের তরফে কিছু আর্থিক সহায়তা এবং শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি এসেছে। তবে সবচেয়ে বড় সহায়তা এসেছে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও উৎসাহ থেকে, যারা তাকে শুধু দয়া নয় — সম্মান দিয়েছে।
শেষ কথা: এক পা দিয়ে শুরু, দুই চোখে পৃথিবী জিতল
পৃথিবীর সব যুদ্ধ হাত দিয়ে লড়া যায় না। কিছু যুদ্ধ লড়তে হয় চোখ দিয়ে, কিছুটা সাহস দিয়ে, আর কিছুটা ভরসা দিয়ে। পারভেইজের গল্প সেই সাহসের গল্প — যেখানে শরীর থেমে গেলেও, মন কোনোদিন থামে না।
এক পা দিয়ে সে প্রতিদিন স্কুলে গিয়েছে, কিন্তু চোখ দুটোয় ছিল কোটি মানুষের আশা। সে প্রমাণ করেছে — জয় শুধু দেহের নয়, মন যে অদম্য, তাকেই একদিন ইতিহাস লিখতে হয়।
“পায়ের অভাব নয়, সাহসের অভাব থাকে না।” — এই একটি বাক্যে যেন গাঁথা আছে হাজারো পারভেইজের গল্প।
আমরা যদি পারি, চলুন আমরা এই গল্পগুলোর পাশে দাঁড়াই।
চলুন হাত বাড়িয়ে দিই — যাতে তারা শুধু হেঁটে না চলে, উড়তে শেখে।
Your comment will appear immediately after submission.