জীবনে কিছু গল্প থাকে — যা শুধু পড়ে নয়, বুকে ধরে রাখতে হয়।
এই গল্পটা ঠিক তেমন — একটা ছেলের গল্প, যার সকাল শুরু হতো খালি পেটে, আর রাত শেষ হতো বাতির নিচে বই পড়ে। যেখান থেকে ও এসেছিল, সেখানে স্বপ্ন দেখাও ছিল একপ্রকার ‘অপরাধ’। তার পায়ে ছিল ছেঁড়া জুতো, কিন্তু চোখে ছিল আগুন। সে বিশ্বাস করতো, “জুতো ছেঁড়ে যায়, স্বপ্ন না।”
বাবা রাজমিস্ত্রি, মা পরিচারিকা — সংসারে রোজ লড়াই, তবুও সে থামেনি। বাজারে মাল টেনে এনে পড়াশোনা চালাত, বাসন মাজে, দোকানে বসত। একেকটা টাকা জমত একেকটা স্বপ্নের ইট হয়ে।
যখন বন্ধুদের মোবাইল ছিল, তার হাতে ছিল পুরনো কলম আর মায়ের কথায় ভরা সাহস। আজ সে থানার OC — কিন্তু সেই আগুনটা এখনও আছে, এখনও বুকের ভিতর জ্বলছে।
এই গল্পটি শুধু তার নয় — এই গল্পটি তাদের জন্য, যারা বলেছিল,
“আমি গরিব, আমি কীভাবে পারবো?”
এই লেখা তাদের জন্য যারা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায় —
কারণ আজকের এই ছেলেটি প্রমাণ করেছে:
“স্বপ্ন দেখতে টাকা লাগে না — শুধু সাহস লাগে।”
জুতো ছেঁড়া, পেট খালি — কিন্তু চোখে ছিল আগুন
যখন পেট খালি থাকে, তখন অনেকেই স্বপ্ন দেখা ভুলে যায়। কিন্তু কিছু চোখ থাকে, যেগুলো ক্ষুধার চেয়েও তীব্র — সেগুলো আগুনে পোড়ে না, আগুন জ্বালায়। এই গল্পের ছেলেটিও ঠিক তেমন — পায়ে জুতো নেই, পেট চুপ করে আছে, কিন্তু চোখ চুপ নেই। সেগুলো একটার পর একটা স্বপ্নে আলো খোঁজে। চারপাশের ব্যঙ্গ, অবহেলা, আর তাচ্ছিল্যর মাঝেও সে জানত, তার পথটা মাটি দিয়ে শুরু হলেও একদিন কোর্টরুমে গিয়ে শেষ হবে।
কখনও স্কুলের পেছনে, কখনও বাতির নিচে — ওর বই ছিল জ্বলন্ত লণ্ঠন
যে ঘরে কেরোসিন নেই, সেখানে ছেলেটি রাস্তায় খুঁজে নিত আলো। স্কুলের পর পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে পড়ত, যখন লোডশেডিং হতো তখন চায়ের দোকানের বাতির নিচে বসে পড়ত — বইটা যেন তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত অস্ত্র, একেবারে জ্বলন্ত লণ্ঠনের মতো। সে জানত, অন্ধকারে শুধু আলোই পথ দেখায় না, ইচ্ছাশক্তিও দেখায়।
বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি, কিন্তু ছেলে স্বপ্ন দেখতো কোর্টরুমে বসার
বাবার হাতের পাথর-সিমেন্টের গন্ধ আর মায়ের কষ্টে ভরা মুখ — এগুলোর মধ্যে সে খুঁজে পেত শক্তি। কেউ ভাবেনি রাজমিস্ত্রির ছেলে জজের চেয়ারে বসার স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু সেই স্বপ্নটাকে সে লুকায়নি, সে তা বুকের মধ্যে আগুন বানিয়ে রেখেছিল। এবং সেই আগুনেই একদিন পুড়েছিল দারিদ্র্য, পুড়েছিল সমাজের সংশয়।
দিনে কাজ, রাতে পড়া — থেমে না যাওয়ার শপথ
একটা বয়সে ছেলেটা জানত, খালি হাতে স্কুলে গেলে কেউ কিছু দেয় না। তাই দিনে সে কাজ করত — কখনও বাসন মাজত, কখনও ছোট দোকানে দাঁড়িয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু যত ক্লান্তিই হোক, রাত নামলেই সে আর অন্য কারও জন্য নয় — নিজের স্বপ্নের জন্য জেগে উঠত। তার পড়াশোনার সময়টা ঠিক তখনই শুরু হতো যখন অন্যেরা বিছানায় যেত। এই ছিল তার শপথ — থামবে না, যতদিন না সেই রোল নম্বর মেরিটলিস্টে ওঠে।
বাসন মাজা, দোকানদারি — প্রতিটি টাকা ছিল পরবর্তী পরীক্ষার জন্য
বাসন মাজা মানেই তার কাছে কষ্ট নয়, সেটি ছিল বিনিয়োগ — নিজের ভবিষ্যতের জন্য। প্রতিটি ছোটখাটো কাজ, প্রতিটি কষ্টের ঘাম সে জমাত পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের জন্য, এক কাপ চা কম খেয়ে টিউশন ফি বাঁচাত। কেউ জানত না, দোকানের কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার।
মা বলতেন, ‘শরীর গরিব হতে পারে, মন নয়’ — সেই ছিল তার শক্তি
তার মায়ের মুখে ছিল না বড় বড় ভাষণ, ছিল না কোটেশনের জ্ঞান — শুধু ছিল একটাই কথা:
“শরীর গরিব হতে পারে, মন নয়।”
সেই একটা লাইনই তাকে প্রতিদিন আরও শক্ত করে তুলত। ক্লান্ত শরীর, অনাহারী পেট — সবকিছুর ওপরে ছিল সেই কথাটা। এই বাক্যই ছিল তার রক্তে চলা একধরনের জ্বালানি — যা তাকে পড়াশোনার পথে চালিত করেছে আগুনের মতো।
মক টেস্ট থেকে মেরিট লিস্ট — রোল নম্বরটা যেন গর্জে উঠল
মক টেস্ট মানেই ছিল তার জন্য যুদ্ধের মহড়া। প্রতিবার প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে সে ভাবত, “আজ যদি না পারি — কালও কি পারব?” কিন্তু সেই ভয়ও তাকে ঠেকাতে পারেনি। প্রতিটি ভুল উত্তর, প্রতিটি কাটাকাটি ছিল তার জন্য শেখার চিহ্ন — হারের নয়।
ছোট এক গ্রাম থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিল, সেখানে একমাত্র জ্ঞানই ছিল তার পুঁজি। আর সেই জ্ঞান নিয়ে, শহরের কোলাহলের মাঝেও সে তৈরি করেছিল নিজের পথ — কলকাতা থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে UPSC হলরুম।
ছোট গ্রাম থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে UPSC হলরুম
শুরুটা হয়েছিল মাটির ঘর থেকে, যেখানে ছাউনি দিয়ে বৃষ্টি পড়লে জল পড়ত বইয়ের ওপর। তারপর একদিন সে কলকাতায় পৌঁছায় — অচেনা শহর, অজানা ভাষা, তবু লক্ষ্য একটাই: UPSC. কোচিং সেন্টারে গিয়ে যখন সে প্রথম মক টেস্টে ৩৭% পায়, তখনই নিজেকে বলেছিল, “এই ৩৭ একদিন 137-এ পরিণত হবে।” সে কথা রেখেছিল।
সেদিন পুরো গ্রাম মিষ্টি খাচ্ছিল, শুধু সে চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল
যেদিন রেজাল্ট বের হলো, তার রোল নম্বরটা মেরিট লিস্টে এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল — যেন সেটা কেবল এক নম্বর না, বরং এক গর্জন।
গ্রামে ঢোকার মুখে সবাই মিষ্টির থালা সাজাচ্ছে, আত্মীয়-প্রতিবেশী গর্বে বুক ফুলিয়ে কথা বলছে — কিন্তু সে?
সে চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল।
বাইরে হইচই, ভেতরে কেবল একটাই কথা ঘুরছিল:
“এই যে হলো — আজ থেকে শুধু আমার না, আমার বাবারও পরিচয় বদলে গেল।”
এখন সে থানার OC — অথচ মাটির গন্ধটা এখনো বুকের ভিতর
আজ তার কাঁধে রয়েছে একটি থানার দায়িত্ব। সে এখন অফিসার ইন চার্জ — থানার OC। কড়া চোখ, শক্ত গলা, আর সিদ্ধান্তে অটল — যেন আইন-শৃঙ্খলার পাহারাদার।
তবু ভেতরে কোথাও একটা নরম সুর বাজে, সেই মাটির সুর — যেখানে সে একদিন খালি পায়ে স্কুলে যেত, কাঁধে ছেঁড়া ব্যাগ নিয়ে।
যখন কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে, “এত বড় হলে কি এখন আর গ্রামে যান না?”, সে হেসে বলে,
“আমি কোথাও যাই না, আমি সবসময় ওখানেই থাকি — মাটির গন্ধ এখনও বুকের ভিতর বেঁচে আছে।”
যেখান থেকে শুরু, সেখানেই সে বারবার ফিরে যায় — স্কুলের সেই ভাঙা বেঞ্চে
প্রতিবার ছুটি পেলেই সে ফিরে যায় সেই স্কুলে — যেখানে একদিন মাটি লেগে থাকা বেঞ্চে বসে সে প্রথম শিখেছিল ‘স্বপ্ন’ শব্দের মানে।
শিক্ষকরা এখন গর্ব করে বলেন, “আমাদের ছাত্র আজ থানার বড় অফিসার।”
সে যখন স্কুলে যায়, তখন পেছনে চলে যায় সময়। চোখে জল আসে — কিন্তু সে মুখে হাসে।
গরিব ছেলেদের হোস্টেল তৈরি করেছে — যেন আর কেউ বাতির নিচে না পড়ে
সেই স্কুলের পেছনেই এখন একটা ছোট হোস্টেল গড়ে উঠেছে — যার নাম:
“আলোকছায়া ছেলেদের আবাস”
এটি তার নিজের হাতে তৈরি, নিজের আয়ে, নিজের স্বপ্নে।
যেন কেউ আর কুয়াশা ভরা ভোরে, খালি পেটে পড়তে বসতে না হয়।
সে বলে,
“আমি তো কেবল একটা রোল নম্বর — কিন্তু তারা যেন হয় আলোর উৎস।
FAQ – পাঠকদের মনে জাগা কিছু সাধারণ প্রশ্ন
ছেলেটি কোথা থেকে এসেছে?
সে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে — যেখানে এখনো কাঁচা রাস্তা, আর স্কুল মানেই টিনের চালের একটা ঘর।
কিন্তু তার মানসিক শক্তি আর মায়ের সাহস তাকে পৌঁছে দিয়েছে শহরের মোহড়া ছাড়িয়ে, একেবারে প্রশাসনের কেন্দ্রে।
তার বাবা-মা এখন কী করেন?
তার বাবা এখনো রাজমিস্ত্রির কাজ করেন — বলতেই চান না ছেলে বড় অফিসার, যেন সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার তৃপ্তিটাই বড়।
মা? তিনি সকালবেলা পুজো দিয়ে বলেন,
“আজও আমার ছেলে নিজের মতো মানুষ থাকুক — সেটাই বড়।”
সে কীভাবে কোচিং ছাড়া প্রস্তুতি নিয়েছিল?
ইন্টারনেট ছিল না, স্মার্টফোন ছিল না।
সে পড়েছিল পুরনো বই, বন্ধুদের নোট, আর সরকারি লাইব্রেরির পুরনো পত্রিকা থেকে।
রাতের পর রাত শুধু আলো ছিল একটি — সাহসের।
সমাজ বা সরকার সাহায্য করেছিল কি?
প্রথমদিকে কেউ তাকে চিনত না। সে নিজেই নিজের পথ গড়েছে।
তবে এখন, তার গল্প শুনে অনেকেই এগিয়ে আসছেন — যেন আরেকজন ‘সফলতা’ শুধু কাগজে না, জীবনে লিখে দিতে পারে।
শেষ কথা: স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না — শুধু সাহস লাগে
একদিন জুতো ছিল না, কিন্তু ছিল জেদ।
একদিন বাসন মাজতে মাজতে ভিজে গিয়েছিল হাত, কিন্তু ছিল চোখে আগুন।
সে ছেলে আজ থানার অফিসার, কিন্তু তার বুকের ভিতর এখনো বাজে সেই মায়ের কথা —
“শরীর গরিব হতে পারে, মন নয়।”
এই গল্পটা শুধু একটা ছেলের নয়।
এই গল্পটা প্রতিটি সেই ছেলের জন্য —
যে এখনো ভাঙা চৌকিতে বসে পড়ে, যার মা এখনো লন্ঠন জ্বালিয়ে বলে, “পারবি রে, একদিন তুইও পারবি।”
🔖 “যে ছেলেটি একদিন বাতির নিচে পড়েছিল, আজ সে আলো জ্বালায় অন্যদের জন্য।”
তুমি যদি এই লেখা পড়ে নিজের ভিতরে কোনো আলো দেখতে পাও —
তবে জেনে নিও,
তোমার যাত্রাটাও শুরু হয়ে গেছে।
Your comment will appear immediately after submission.