বৃষ্টি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণ, মাত্রা ও সময়কাল দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে যেমন শস্য উৎপাদনে সহায়তা হয়েছে, তেমনি বন্যা, ভূমিধস ও জলাবদ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রবন্ধে বৃষ্টির সুফল ও কুফল বিশ্লেষণের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভূটানে বিগত বছরের ক্ষয়ক্ষতির গবেষণাধর্মী চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বৃষ্টির সুফল
১. কৃষি উৎপাদনে সহায়তা
বৃষ্টির পানিতে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৬৫% কৃষিজমিতে সেচের প্রয়োজন কমে যায়। FAO (2023) অনুযায়ী, সঠিক মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত কৃষিতে উৎপাদন ১৫-২০% পর্যন্ত বাড়ায়।
২. ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃপুনরায় পূরণ
Central Ground Water Board (India) জানায়, ২০২৩ সালে বর্ষাকালে বৃষ্টির মাধ্যমে উত্তর ভারতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ৩.৫ মিটার পর্যন্ত পুনরুদ্ধার হয়।
৩. পরিবেশগত ভারসাম্য
বৃষ্টির ফলে বনাঞ্চল জীবন্ত থাকে, বন্যপ্রাণী আশ্রয় পায়, এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
বৃষ্টির কুফল
◼️ বাংলাদেশ
- ২০২২ সালের জুন-জুলাই: সিলেট ও সুনামগঞ্জে অতিবৃষ্টিজনিত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ, ২৫০০+ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি।
- বাংলাদেশ সরকার ও UNDP এর যৌথ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১-২০২৩ সালে বৃষ্টিজনিত বন্যায় মোট আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৫,২০০ কোটি টাকা।
◼️ ভারত
- ২০২৩ বর্ষা মৌসুমে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও মহারাষ্ট্রে ভূমিধস ও ফ্ল্যাশ ফ্লাডে প্রাণহানি ঘটে ১,৮৫০+ জনের এবং বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ৩ লাখ পরিবার।
- NDMA (India) রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৃষ্টিজনিত দুর্যোগে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল প্রায় ₹২৭,০০০ কোটি।
◼️ নেপাল
- ২০২৩ সালে বর্ষায় ভূমিধস ও নদীর প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৭টি জেলা, মৃত্যু হয় ১২০ জনের, এবং ৫৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় (Nepal Disaster Risk Reduction Portal)।
- বৃষ্টিজনিত কারণে কাঠমুন্ডু উপত্যকাতে জলাবদ্ধতা ও রাস্তাঘাটের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
◼️ ভূটান
- ভূটানে বৃষ্টিপাত কম হলেও ২০২১ সালে দক্ষিণাঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮টি জেলা। ADB রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বৃষ্টিজনিত অবকাঠামো ক্ষতি প্রায় USD 11 মিলিয়ন।
বৃষ্টিজনিত ক্ষয়ক্ষতি (২০২১-২০২৩)
দেশ | প্রভাবিত মানুষ | আর্থিক ক্ষতি (প্রায়) | উল্লেখযোগ্য দুর্যোগ |
---|---|---|---|
বাংলাদেশ | ৯০ লাখ+ | ৫,২০০ কোটি টাকা | সিলেট-সুনামগঞ্জ বন্যা (2022) |
ভারত | ৩০ লাখ+ পরিবার | ₹২৭,০০০ কোটি | হিমাচল ভূমিধস (2023) |
নেপাল | ১ লাখ+ | $52 মিলিয়ন+ | পাহাড়ি ভূমিধস (2023) |
ভূটান | ৩০,০০০+ | $11 মিলিয়ন | দক্ষিণ ভূটান বন্যা (2021) |
বিশ্লেষণ
▶ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
IPCC Sixth Assessment Report অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষার সময়কাল ও ঘনত্ব বেড়েছে। এটি স্বাভাবিক শস্যচক্রকে ব্যাহত করছে এবং বন্যা প্রবণতা বাড়াচ্ছে।
▶ আর্থ-সামাজিক প্রভাব
- দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়
- নারী ও শিশুরা আশ্রয়হীন ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে
- খাদ্য সংকট ও শিক্ষায় বিঘ্ন ঘটে
করণীয়
করণীয় | বাস্তবায়নের উপায় |
---|---|
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ | Rainwater harvesting বাধ্যতামূলক |
দুর্যোগ প্রস্তুতি | উপজেলা পর্যায়ে আশ্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি |
অবকাঠামো উন্নয়ন | পাহাড়ি এলাকায় সাবলীল ড্রেনেজ |
কৃষি অভিযোজন | সল্পজল প্রয়োজন ফসল চাষে উৎসাহ |
বৃষ্টি একদিকে জীবনদায়ী, অন্যদিকে প্রাণঘাতী। এর সুফল সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে এবং কুফল হ্রাস করতে হলে চাই গবেষণানির্ভর পরিকল্পনা, দুর্যোগ প্রস্তুতি, ও প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষের জীবনে বৃষ্টির প্রভাব পড়ে—তাই সময় এসেছে এর দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার।
📚 তথ্যসূত্র:
- FAO Reports (2023)
- Bangladesh Disaster Preparedness Center (BDPC)
- National Disaster Management Authority (India)
- Nepal Disaster Risk Reduction Portal
- ADB Bhutan Country Report (2021)
- IPCC Sixth Assessment Report (2022)